সুজয় দত্ত, পুরুলিয়া:
হায়রে সাধের রুখামাটি
খাঁটি সোনার চায়েঁও খাঁটি…
নিজের মাতৃভূমিকে এভাবেই বিশ্বের দরবারে পরিচিত করিয়েছিলেন তিনি। তাঁর লেখা “পুরুল্যা তর লেলহা ছেলহা ও তর টেনাও জুটে নাই”—আঞ্চলিক টানেই এক বাক্য, অথচ এর মধ্যেই যেন ফুটে ওঠে পুরুলিয়ার হাসি, কান্না, দুঃখ, আনন্দ। সেই কণ্ঠস্বর আর ফিরবে না। পুরুলিয়ার রামনগরের সন্তান, ঝুমুর কবি, কৌতুক অভিনেতা, গায়ক, সুরকার, শিক্ষক কুচিল মুখার্জী আর নেই। বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ৮১ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হলেন। জন্ম ১৯৪৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। আলকুশি ছদ্মনামে লেখা অজস্র ঝুমুর রয়ে গেল পুরুলিয়ার কাছে।

কুচিল মুখার্জী শুধু একজন শিল্পী নন, ছিলেন জেলার সাংস্কৃতিক আত্মার প্রতীক। হাসির আড়ালে সমাজের ব্যথা তুলে ধরতেন তিনি। মঞ্চ হোক বা ক্যামেরা, তাঁর সংলাপ, মুখভঙ্গি, আঞ্চলিক টান মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক জীবন্ত চরিত্র—“আমাদের লোকটা”, পাশের পাড়ার চেনা মানুষ।
ঝুমুর, কৌতুক নাটক, গ্রামবাংলার টানাপোড়েন—সবখানেই তাঁর লেখা আজ কিংবদন্তি।
“পুরুল্যা তর লেলহা ছেলহা…”,
“এরে আমার দিয়াশল টা নিয়ে গেলি রে…”,
“ই শালারা চাষ করবেক…”.

তাঁর জনপ্রিয় অ্যালবাম—“ঠেলকে নিয়ে মলকে দিলি”, “হুচকে নিয়ে পুঁচকে দিলি”, “দাদুর ব্রেক ফেল”, “সিঁধ খড়ি”, “বাঁচাও সাধুবাবা”—কেবল মেলার মাঠেই নয়, আজও ভেসে বেড়ায় সোশ্যাল মিডিয়ার পর্দায়।
শুধু অ্যালবাম বা যাত্রাপালা নয়, চলচ্চিত্রের জগতেও তাঁর বলিষ্ঠ উপস্থিতি রয়েছে। হিন্দি ছবি লুটেরা-তে অভিনয়, একাধিক বাংলা ধারাবাহিকে উপস্থিতি, আবার প্রখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদারের সজনী গো সজনী ছবিতে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে অবদান। সেই ছবির একাধিক গানে কুমার শানুর কণ্ঠস্বর ছুঁয়ে গিয়েছিল দেশজুড়ে মানুষকে।
এক আশ্চর্য সমাপতন, কুচিলবাবুর জন্মদিনেই জন্ম নিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪)। তাঁদের দীর্ঘ বন্ধুত্ব পর্দাজুড়ে আলো ছড়িয়েছিল। বুদ্ধদেববাবুর প্রায় সব ছবিতেই কোনও না কোনও চরিত্রে দেখা মিলেছে কুচিলবাবুর। তাঁর হিন্দি ছবি আনোয়ার কা আজব কিসসা-য় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি ও পঙ্কজ ত্রিপাঠির মতো বলিউডের দুই বলিষ্ঠ অভিনেতার সঙ্গে একই পর্দায় অভিনয় করেছেন তিনি।
কিন্তু তাঁর গল্প বোঝার জন্য নাটক-যাত্রার ভেতরে ঢুকতে হয়। কারণ, এমন শিল্পী শতাব্দীতে একজনই জন্ম নেন।
রামনগরের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম কুচিল মুখার্জীর। বাবা হরিপদ মুখার্জী ছিলেন শিক্ষক ও পুরোহিত। বাড়ির কড়া অনুশাসনে ঝুমুর গান শোনার সুযোগ ছিল না। অথচ গ্রামের মাঠে কান্টাডি থেকে আসা যাযাবর শিল্পীদের ঝুমুরগানই টেনে নিত ছোট্ট কুচিলকে। মা ছিলেন কাশীপুর রাজবাড়ির গায়ক রাখাল গোস্বামীর দৌহিত্রী—তাঁর মধ্যেই ছিল সংগীতের উত্তরাধিকার। তাই ছেলেকে লুকিয়ে লুকিয়ে মদত দিতেন ঝুমুরের আসরে যাওয়ার। গুরু হিসেবে পেলেন নিমাই মালোয়ারকে।
প্রথম বড় সুযোগ এল ১২-১৩ বছর বয়সে। শ্যামপুরের এক বাঈনাচের আসরে জমছিল না গান, হঠাৎ মঞ্চে ডাকা হল কুচিলকে। শিশুশিল্পীর কণ্ঠে ঝুমুর শুনে মুগ্ধ হলেন দর্শক। এরপর শুরু হল নিরন্তর অনুশীলন। মামাবাড়ির নডিহায় পিসিমার উদ্যোগে চলল গানবাজনা। তারপরই তাঁর ডাক পড়ল কলকাতা আকাশবাণীতে। মাত্র ১৭-১৮ বছর বয়সে রেডিয়োতে সম্প্রচারিত হল তাঁর তিনটি ঝুমুর গান। বাবা শুনে অবাক, গর্বে ভরে উঠলেন। ছেলের লেখা পুরোনো সব গান ফিরিয়ে দিলেন। সেটাই ছিল শিল্পীর প্রথম বড় পুরস্কার।

এরপর থেকে কুচিল মানেই ঝুমুরের প্রাণ। যাত্রাপালায় বিবেকের ভূমিকায় গান আর সংলাপে মাতিয়ে তুলতেন আসর। বাবার ভয়ে একসময় “আলকুশি” ছদ্মনামে লিখলেও, ততদিনে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে লোকগানের আখড়ায় আখড়ায়। পুরুলিয়ার মাইতি সাউন্ড থেকে প্রকাশিত ক্যাসেট পৌঁছল তরুণ মজুমদারের হাতে। সেখান থেকেই সজনী গো সজনী—যা তাঁকে দিল এক অনন্য পরিচিতি।
গানই নয়, তিনি ছিলেন অভিনেতা। একাধিক বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন। একইসঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। পুরুলিয়ার বেলগুমা হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে পরে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন।
কিন্তু শেষ জীবনে সেই দীপ্তি আর থাকেনি। ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারান কুচিল মুখার্জী। পরিবারের কাছের মানুষদেরও চিনতে পারতেন না। প্রায় পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিলেন স্মৃতিশক্তি। শরীর বেঁচে ছিল, কিন্তু তিনি যেন নিজের ভেতরেই হারিয়ে গিয়েছিলেন।
তবু তাঁর অবদান অমর। ঝুমুরের ভাণ্ডারে তাঁর লেখা ও সুর দেওয়া গান আজও বাজে মেলায়, গ্রাম্য আড্ডায়, এমনকি ইউটিউব-ফেসবুকের ভিডিওতেও। মানভূম-পুরুলিয়ার প্রকৃতি, জীবন, হাসি-কান্না, দুঃখ-সংগ্রাম—সবকিছুর সুর হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
কুচিল মুখার্জী নেই। অথচ তিনি আছেন—মাটির গানে, ঝুমুরের কথায়, পুরুলিয়ার প্রাণস্পন্দনে।
তথ্য ঋণ : ড. দয়াময় রায় ও স্বরূপ দত্ত










Post Comment