সুইটি চন্দ্র, সিল্লি(ঝাড়খণ্ড) :
একা একা ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল সে। নইলে যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে ধরতে ঝাড়খণ্ড আর বাংলার বন দফতর নাকানিচোবানি খেয়েছে, সে কি এত সহজে ধরা পড়ে? এ যেন ধরা পড়া নয়, ধরা দেওয়া। টানা ছ’মাস প্রেমিকা জিনাতের সন্ধানে বাংলা-ঝাড়খণ্ড তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ানো এক ব্যর্থ বনজারা প্রেমিক যেন শেষমেশ নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করল — এক গৃহস্থের ঘরে, একটা সাধারণ বিছানার পাশে, মানুষের চোখে চোখ রেখে।

ছ’মাস ধরে দুই রাজ্যের আটটি জেলার প্রায় হাজার কিলোমিটার বিস্তীর্ণ বনভূমি আর গ্রামাঞ্চলে নিঃশব্দে পায়চারি করে বেড়িয়েছিল এক পুরুষ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। একা। নিঃসঙ্গ, অথচ শক্তিমান। কখনও পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডির অযোধ্যা পাহাড়, কখনও ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি, কখনও আবার দক্ষিণ বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়ে তার দেখা মিলেছে। তার এই যাত্রা যেমন জিনাত নামের বাঘিনীর টানে শুরু, তেমনি শেষ হল এক গৃহস্থের শোবার ঘরে।

ঘটনাস্থল ঝাড়খণ্ডের রাঁচি জেলার সিল্লি থানার অন্তর্গত মারদু গ্রাম। বুধবার ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ গ্রামেরই ঠিকা শ্রমিক পুরন্দর মাহাতোর ঘরে ঢুকে পড়ে সেই বাঘটি। দরজা বন্ধ ছিল না। বৃষ্টির পরে হালকা ভেজা মাটিতে রেখে যাওয়া পায়ের ছাপ দেখেই বোঝা যায়, বাঘটি বেশ কিছুক্ষণ গ্রামের ভেতরেই ঘুরেছে।

ঘরের ভেতরে ঢুকেই বাঘটি গর্জন করে ওঠে। বিছানার উপর লাফিয়ে ওঠে। আশ্চর্যের বিষয়, তার মধ্যে কোনও তাড়াহুড়ো ছিল না। যেন ঘুমানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না। পুরন্দর মাহাতো তখন ঘরে ছিলেন তাঁর কিশোরী কন্যা ও দূর সম্পর্কের কিশোরী শ্যালিকার সঙ্গে। কোনওরকমে মেয়েদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি নিজেই। আর ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হয় প্রায় একঘণ্টার এক নিঃশব্দ স্নায়ুযুদ্ধ — একপাশে বাঘ, অন্যপাশে পুরন্দর।

পুরন্দর বলেন, “সেই মুহূর্তে একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল — যদি আমি ভয় পাই, আর যদি ও সেটা বুঝে ফেলে, তাহলে আমি মরে যাব। আমি ঠিক করেছিলাম, একদৃষ্টে ওর চোখে তাকিয়ে থাকবো। না পালাব, না চিৎকার করবো। তখনই বুঝলাম, এটা একটা যুদ্ধ — নিজের স্নায়ুর উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে, হার নিশ্চিত।” তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে দরজা তালা বন্ধ করে দেন পুরন্দর বাবু।

ঘরের ভিতর বসে আছে বাঘ। খবর পেয়ে ঘর ঘিরে ফেলে ঝাড়খণ্ড বন দফতর। প্রবল বৃষ্টির মাঝেও বাঘ দেখা পরব লেগে যায়। শুরু হয় বাঘ বন্দি অভিযান। তবে এই বাঘবন্দির ঘটনাও যেন এক নাটকীয় উপাখ্যান।

বন দফতরের দল পালামৌ টাইগার রিজার্ভের একটি রেসকিউ খাঁচা এনে ঘরের মুখে রাখে। ফাটানো হয় পটকা। বিকেল প্রায় ৫টা ৪০ মিনিট নাগাদ বাঘটি নিজেই ঢুকে পড়ে খাঁচায়।

গর্জন করতে করতে, হুংকার ছেড়ে নিজের পায়েই টেনে দেয় খাঁচার ‘ড্রপ গেট’। মুহূর্তে ছড়ায় উত্তেজনা। আতঙ্কে বনকর্মীরা দু’টি ট্রাঙ্কুলাইজার গুলি ছোঁড়েন।

কিন্তু দুটিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ফলে কিছুটা ছলনা করেই আবারও খাঁচার দরজা আটকানো হয়। তারপর নীল প্লাস্টিকের চাদরে ঢেকে তাকে তুলে দেওয়া হয় সবুজ রঙের রেসকিউ ভ্যানে। রওনা হয় রাঁচির বিরসা চিড়িয়াখানার দিকে।

বাংলা ঝাড়খণ্ড এই বাঘকে চেনে জিনাতের আশিক বলে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন থেকে এই বাঘের গতিবিধি নজরে আসে বন দফতরের। ৩১ ডিসেম্বর ঝাড়খণ্ডের চান্ডিল অঞ্চলে এই বাঘ একটি বাছুর হত্যা করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। এরপর দলমা থেকে বান্দোয়ান, বান্দোয়ান থেকে বেলপাহাড়ি, দক্ষিণ বাঁকুড়া, আবার দলমা— এইভাবে কয়েক মাস ধরেই সে ঘুরে বেরিয়েছে। বন দফতরের বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে আসা ‘জিনাত’ নামের এক বাঘিনীর টানেই হয়তো এই পুরুষ বাঘটি এত দূর পর্যন্ত হেঁটে এসেছিল। বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়েই কিছুদিন জিনাতের অবস্থান ছিল।

গত ফেব্রুয়ারিতে শেষবার বনদফতর তাকে খাঁচা বন্দি করার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু অনুমোদন মেলেনি। এরপর গ্রীষ্ম কাটিয়ে বর্ষা শুরু হতেই সে আবার যাত্রা শুরু করে — দলমা থেকে চান্ডিল, তারপর খুঁটি হয়ে সোজা রাঁচি জেলার সিল্লিতে চলে আসে।

ঝাড়খণ্ড বন দফতরের প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) পরিতোষ উপাধ্যায় জানান, “রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে বন্দি করা হয়েছে। বহুদিন ধরে বাংলা-ঝাড়খণ্ডে ঘুরছিল। আপাতত তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তারপর তাকে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে রেডিও কলার পরানো হবে কিনা, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমাদের কাছে এখন রেডিও কলার নেই।”

যে ঘরে বাঘটি ঢুকেছিল, সেই ঘরের অবস্থা দেখে বোঝা যায় তার তাণ্ডব কতটা ছিল। লোহার ট্রাঙ্ক চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছে, খাট-জিনিসপত্র উলটপালট।

তবে পুরন্দর মাহাতোর মুখে শুধু একটাই কথা — “ঘরের যা ক্ষতি হয়েছে, তার হিসেব বন দফতরকে জানিয়েছি। কিন্তু আমি যা পেয়েছি, তা এক নতুন জীবন। আমি যেন আবার জন্মেছি।”
Post Comment