সুজয় দত্ত, পুরুলিয়া:
কোজাগরীর আলোতে অন্ধকার খোঁজে লক্ষ্মী পেঁচা। যাতে তার জ্বলন্ত দৃষ্টি দেখতে পায় অতল আঁধারের অভ্যন্তর। সেই লক্ষ্মী পেঁচা কেন দেখা যাচ্ছে না ইদানিং?
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই হারাই’ সদা ভয় হয়,
হারাইয়া ফেলি চকিতে।” (পূজা ও প্রার্থনা )
সেই লক্ষ্মী পেঁচাকে বারবার দেখা গেছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়।
“…হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে…”
“…লক্ষ্মী পেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?…”
দেবী লক্ষ্মীর বাহন নামে তার খ্যাতি। একট সময় বাংলার গ্রামে গ্রামে নিশাচর পাখিটি ইঁদুর-শিকারি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। খেতের ধান আর গোলার ধান নষ্ট করে যে ইঁদুর, তারই শিকার করে
গাঁয়ের মানুষের কাছে লক্ষ্মীর প্রতিরূপ হয়ে উঠেছিল এই পাখিটি।
ভারতের কোনো কোনো প্রদেশে লক্ষ্মী-প্যাঁচার কদর আবার সাংঘাতিক। গুজরাটে লক্ষ্মী-প্যাঁচা বসে সাক্ষাৎ দেবী হয়েই। সেখানে সে পূজিত হয় ‘রেবি দেবী’ নামে।
লক্ষ্মী-প্যাঁচার ইংরেজি নাম বার্ন আউল (Barn Owl)। বৈজ্ঞানিক নাম ‘টাইটো অ্যালবা’।
সেই সাদা পেঁচা কি নিরুদ্দেশের পথে? একটা সময় মনে করা হচ্ছিল, একদিকে গগনচুম্বী টাওয়ারের তরঙ্গ অন্যদিকে চাষের জমিতে যথেচ্ছভাবে কীটনাশক ব্যবহারের। জেরেই জঙ্গলমহল এলাকাতেও আর সেভাবে লক্ষ্মী পেঁচার দেখা মিলছে না। শহরের গ্রাস যেভাবে সদর থেকে ব্লক মফস্বলকে যেভাবে ফ্ল্যাট কালচারে মুড়ে দিচ্ছে তাতে উধাও হয়ে যাচ্ছে গাছের কোটর, মাটির বাড়ির মোটা দেওয়াল। আর তাতেই বাস্তুহারা হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মী পেঁচা। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ শ্রেণিতে এই প্রকারের পেঁচা তিন নম্বরে রয়েছে। পক্ষী বিশারদরা বলছেন, জঙ্গলমহলেও চাষের জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে। কীটনাশক প্রয়োগে আমন ধানের জমিতে ইঁদুর উধাও। ফলে লক্ষ্মী পেঁচা কমে আসার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। কারণ এই প্যাঁচা মূলত ইঁদুর খায়। একটা সময় জঙ্গলমহলের কৃষি জমিতে সেভাবে কীটনাশক ব্যবহার হতো না। আমন ধানের জমিতে ছিল ইঁদুরের উপদ্রব। সহজে লক্ষ্মী পেঁচা যাতে মেঠো ইঁদুর শিকার করতে পারে তার জন্য জমিতে লম্বা বাঁশ পুঁতে দিতেন চাষিরা। তাতে এসে বসত লক্ষ্মী পেঁচা। তার প্রখর দৃষ্টি খুঁজে বেড়াত মেঠো ইঁদুর। এখন আর তা দেখা যায় না।
পক্ষীবিশারদদের গবেষণা থেকে এও জানা গিয়েছে যে অযোধ্যা পাহাড়ের একাংশে লক্ষ্মী পেঁচা ঘরে পোষা হয়। এমনটা কিন্তু বেআইনি। চোরা শিকারিদের নজরে যেভাবে থাকে হুতুম পেঁচা সেভাবে কিন্তু লক্ষ্মী পেঁচাকে শিকার কর হয় না। এটাই বাঁচোয়া।
আজ থেকে এক দশক আগেও সন্ধ্যা হলেই পুরুলিয়ার বনাঞ্চলে চোখে পড়ত লক্ষ্মী পেঁচা। দিনের বেলায় কার্যত অন্ধ হয়ে লোকালয়ে চলে আসত তারা। ঝালদা, বাঘমুন্ডি, আড়শায় মাঝে মধ্যেই লক্ষ্মী পেঁচা উদ্ধার হতো। উঠে আসত সংবাদ শিরোনামে। বর্তমানে সেই ছবি সেভাবে দেখা যাচ্ছে কই?
তবে আশার আলো দেখাচ্ছেন, পুরুলিয়ার ডিএফও অঞ্জন গুহ। তিনি বলেন, “লক্ষ্মী পেঁচার সংখ্যা বাড়ছে। জেলায় যে সমস্ত ট্যুরিস্টরা আসেন তাদের মধ্যে যারা বার্ড ওয়াচিং’ করেন, তাদের সাথে আমি কথা বলেছি। দেখা যাচ্ছে এখানে লক্ষ্মী পেঁচার সংখ্যা বাড়ছে এবং ভালোভাবে তাদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। অনেকে পেঁচা শাবকও দেখতে পেয়েছেন। তবে এটা ঘটনা যে শহরাঞ্চলে লক্ষ্মী পেঁচা আমাদের খুব বেশি চোখে পড়ে না। এর একমাত্র কারণ আলো। প্রকৃতিগত ভাবে লক্ষ্মী পেঁচা অন্ধকার পছন্দ করে। আলোর আধিক্য তাদের শহরাঞ্চলে আসতে দিচ্ছে না। আমি অনেক দিন ধরে খোঁজ খবর নিচ্ছি। অনেকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। সবার সাথে আমাদের পর এটাই বলার যে লক্ষ্মী পেঁচার সংখ্যা কমেনি বরং আরো নতুনভাবে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। তবে মোবাইল টাওয়ারের কারণে লক্ষ্মী পেঁচার সংখ্যা শহরাঞ্চলে কমছে কি না সে ব্যাপারে বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োজন। কীটনাশক ব্যবহারে মেঠো ইঁদুরদের সংখ্যা কমছে কি? লক্ষ্মী পেঁচাতো শুধু মেঠো ইঁদুর খায় না, তারা টিকটিকি, ছোটো বড়ো পোকা এসবও খায়। তবে কীটনাশকের এবং রাসায়নিকের ব্যবহার সার্বিকভাবে ক্ষতিকর। আমাদের পুরুলিয়া জেলার অধিবাসীরা আছেন, তাদের আমি বলব যতটা সম্ভব জৈব সার ব্যবহার করা হোক।”
কোজাগরী পূর্ণিমায় অন্ধকারের খোঁজে লক্ষ্মীর বাহন। উজ্জ্বল আলো আলোকিত করছে সমাজ কিন্তু ভিটেছাড়া করছে তাদের। এর সমাধান সূত্র কি আদৌ খুঁজে পাওয়া সম্ভব?
Post Comment