insta logo
Loading ...
×

পুরুলিয়ায় যাত্রার নবজাগরণ — ‘পাঞ্চজন্য’-র ‘ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া’ মাতালো রবীন্দ্র ভবন

পুরুলিয়ায় যাত্রার নবজাগরণ — ‘পাঞ্চজন্য’-র ‘ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া’ মাতালো রবীন্দ্র ভবন

নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া:

বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প যাত্রাপালা— যে শিল্প একসময় বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিনোদনের পাশাপাশি সমাজচেতনা জাগ্রত করত, আধুনিকতার চাপে সেই যাত্রা যখন প্রায় বিস্মৃত, তখনই তার পুনর্জাগরণের স্বপ্ন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে পুরুলিয়া পাঞ্চজন্য। করালগ্রাসী করোনার অব্যবহিত পর, ২০২২-২৩ সালে পুরুলিয়ার কয়েকজন সংস্কৃতিসচেতন মানুষ একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যাত্রাকে আবার সমাজ জীবনের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনবেন। সেই ভাবনা থেকেই ২০২৩ সালে জন্ম নেয় পুরুলিয়া পাঞ্চজন্য। প্রতিষ্ঠার পর বছরেই তাদের প্রথম প্রযোজনা ছিল প্রসাদ কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা “নরনারায়ণ”— জন্মেজয় চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনা ও নির্দেশনায়। ওই পালাটি সারা পুরুলিয়াজুড়ে বিপুল সাফল্য পেয়েছিল।

সেই সাফল্যের পাথেয় নিয়েই ২০২৫ সালের ৮ নভেম্বর, শনিবার পুরুলিয়া রবীন্দ্র ভবনে মঞ্চস্থ হলো পুরুলিয়া পাঞ্চজন্য-র দ্বিতীয় প্রযোজনা — সুনীল চৌধুরী রচিত, জন্মেজয় চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত “ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া”। সন্ধ্যা ৬টা ৩১ মিনিটে প্রধান অতিথি সিধো কানহু বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশেষ অতিথি পুরুলিয়া পৌর প্রধান নবেন্দু মাহালি, দলের বর্ষীয়ান সদস্য রথুলাল মুখোপাধ্যায়, সহ-নির্দেশক দিব্যেন্দু শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভাশিস গুহ নিয়োগীর উপস্থিতিতে প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। পৌরপ্রধানের ঘন্টা বাদনের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রার ঐতিহ্যবাহী সমবেত সুর বেজে উঠতেই দর্শকপূর্ণ রবীন্দ্র ভবনে নেমে আসে এক ভক্তিমগ্ন পরিবেশ।

পালার প্রেক্ষাপট ষোড়শ শতকের নবদ্বীপ। অদ্বৈতাচার্যের আহ্বানে নিমাই, পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ভেঙে সমাজে মানবধর্ম প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। সমাজসংস্কারের জন্য গৃহত্যাগী নিমাইয়ের বিদায়ের পর তাঁর পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়ার তপস্যাময় জীবন— সেই আবেগঘন কাহিনিই “ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া”-র মূল সুর। যুগে যুগে সমাজের মঙ্গলে আত্মবলিদান করা নারীর অবদানকে যে ইতিহাস প্রায়ই উপেক্ষা করে, সেই বিস্মৃত অধ্যায়কে সুনীল চৌধুরী তাঁর সংলাপ ও দৃশ্য পরিকল্পনায় অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

অভিনয়ে প্রধান চরিত্র নিমাই রূপে নির্দেশক জন্মেজয় চট্টোপাধ্যায় ছিলেন যেন জীবন্ত ‘নদেরচাঁদ’। সংযত অভিনয়, সুললিত স্বরক্ষেপণ ও আবেগের সূক্ষ্ম প্রকাশে তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রে তুলিকা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন মঞ্চে বিষাদের মূর্তি— তাঁর অন্তর্লীন যন্ত্রণা ও নিবেদিত ভালোবাসা দর্শককে আবেগাপ্লুত করেছে। অদ্বৈতাচার্য চরিত্রে ড. দয়াময় রায়ের অভিনয় ছিল দৃঢ় ও সংবেদনশীল— কখনও অভিমান, কখনও ভক্তি, কখনও নিমাইয়ের প্রতি পিতৃসুলভ স্নেহের প্রকাশ।

সহ-চরিত্রগুলির অভিনয়ও প্রশংসার যোগ্য। চাঁদ মহম্মদ চরিত্রে চিন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বিধর্মী শাসকের মানবিক দোলাচলকে নিখুঁতভাবে প্রকাশ করেছেন। এক দৃশ্যে নবাবের হুকুম অমান্য করতে না পারার যন্ত্রণা ও শেষে নিমাইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণের মুহূর্তে তাঁর গাওয়া “ভজ গোবিন্দ, কহ গোবিন্দ” গানে বহু দর্শক কেঁদে ফেলেছেন। ঈশান রূপে দিগ্বিজয় চট্টোপাধ্যায়ের কখনও কখনও সংলাপবিহীন মূকাভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে, লোচন চরিত্রে সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় দুর্দান্ত— বিদ্বেষী থেকে ভক্তে রূপান্তরের দৃশ্যে প্রেক্ষাগৃহে নেমে আসে নীরব আবেগ।

জগাই-মাধাই চরিত্রে সুজয় দত্ত ও জিতেন ওঝা যেমন দেহাভিনয়ে মানানসই, তেমনই সাবলীল সংলাপ উচ্চারণে। আক্কেল চরিত্রে বিনয় কৃষ্ণ পালের কণ্ঠে গান দর্শক মাতিয়েছে, বাচস্পতি ও চাপাল চরিত্রে রাজু গোপাল মুখোপাধ্যায় ও সুদিন অধিকারীর অভিনয়ও যথাযথ। গদাধর- শ্রীমন্ত সেন, নিতাই- গৌতম সিংহ, হরিদাস- সৌমেন মুখোপাধ্যায়, মহেশ- প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ চরিত্রের অভিনেতারা মঞ্চে আবহ তৈরি করেছেন সফলভাবে। গোবিন্দ চরিত্রে শিশু শিল্পী সুপর্ণ দত্ত ও বালক শ্রীকৃষ্ণ রূপে ইমন বন্দ্যোপাধ্যায় দর্শকদের মন জয় করেছেন।

নারী চরিত্রগুলির মধ্যে শচী রূপে তপতী দত্ত মাতৃত্বের আবেগকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কাঞ্চনা (মধুমিতা চট্টোপাধ্যায়) ও আবিদা (বীথিকা মুখোপাধ্যায়)-র সহযোগী অভিনয় পালার দৃশ্যবিন্যাসকে মসৃণ করেছে।

পুরো পালার আলোক নিয়ন্ত্রণ, আবহসংগীত এবং রূপসজ্জার দায়িত্বে ছিল পূর্ব বর্ধমান জেলার মা লক্ষ্মী সাজঘর, যাঁদের কাজ মঞ্চসৌন্দর্যকে আরও উজ্জ্বল করেছে। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে শুরু হয়ে রাত দশটা পর্যন্ত চলে এই ভক্তিমূলক পালা। প্রতিটি দৃশ্যের শেষে দর্শকের হাততালিতে ফেটে পড়ে রবীন্দ্র ভবন।

পেশাদার দল না হয়েও পুরুলিয়া পাঞ্চজন্য-র শিল্পীরা যে মাপের অভিনয়, সংগীত ও নিষ্ঠা দেখিয়েছেন, তা যে কোনো নামী চিৎপুরের দলকেও হার মানাতে পারে— এমনটাই মন্তব্য করেছেন অনেক সংস্কৃতি বিশারদ।

এক কথায়, “ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া” শুধুমাত্র একটি যাত্রাপালা নয়— এটি পুরুলিয়ার সাংস্কৃতিক জাগরণের এক মাইলফলক, যা আবারও প্রমাণ করল, লোকশিল্প এখনও বেঁচে আছে মানুষের হৃদয়ে।

Post Comment