insta logo
Loading ...
×

জন্মদিনেও বঞ্চনার অশ্রু পুরুলিয়ার চোখে

জন্মদিনেও বঞ্চনার অশ্রু পুরুলিয়ার চোখে

বিশ্বজিৎ সিং সর্দার, পুরুলিয়া :

কেউ পালন করছেন বঙ্গভুক্তি দিবস। কারও পালনে কালা দিবস। উভয়ের ক্ষোভ যেন মিলিয়ে দিল পুরুলিয়ার জন্মদিনকে। ৬৯ তম প্রতিষ্ঠা দিবসেও পুরুলিয়ার চোখে বঞ্চনার অশ্রু৷ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলছে দুই পক্ষই।
১৯৫৬ সালের পয়লা নভেম্বর বিহারের বুক থেকে মানভূম জেলা ভেঙে ত্রিভুজাকৃতি একটা অংশ পুরুলিয়া নাম নিয়ে যুক্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। বাংলা ভাষার ওপর জোর করে বিহার সরকার হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার লড়াই ছিল মানভূমের। তার একটা খণ্ডিত অংশের দাবি মানা হলো। কিন্তু মানভূমের ক্রিম অর্থাৎ শিল্পাঞ্চল ধানবাদ, বোকারো, সিংভূম সবই তো রয়ে গেল বিহারে। আর খণ্ডিত পুরুলিয়ায় আজও কেন নির্মাণ হল না একটাও শিল্প? প্রশ্ন তুলেছেন বঙ্গভুক্তির আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা নেওয়া লোকসেবক সংঘের বর্তমানকে সচিব সুশীল মাহাতো।
৬৯তম বঙ্গভুক্তি দিবস পালিত হলো ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘড় পুরুলিয়া শহরের শিল্পাশ্রমে। এখানে ভাষা সেনানিদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। ছিলেন পুরুলিয়ার পুরপ্রধান নবেন্দু মাহালি। এই অনুষ্ঠান শেষে পদযাত্রা হয় পুরুলিয়া শহরে। শহরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে জমায়েত করে এই দিনটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন লোকসেবক সংঘের নেতারা।
এদিকে বরাবরের মতো এবারও বঙ্গভুক্তি দিবসকে কালা দিবস হিসেবে পালন করে আদিবাসী কুড়মি সমাজ। এই সামাজিক সংগঠনের মূল খুঁটি মূল মানতা অজিত প্রসাদ মাহাতো। তিনি বলেন, ” অখণ্ড মানভূমের দাবি রাখছি। মানভূমের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বঞ্চিত রাখার কৌশল হলো বঙ্গভুক্তি। পুরুলিয়া বাংলায় এসে বঞ্চনা ছাড়া কিছুই পায়নি।”
অন্যদিকে পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে সেই ৫৬ সালের এক উদ্দীপক কাহিনী শোনালেন নবতিপর ভাষা সৈনিক কাজল সেন। ১৯৫৬ সালে শিল্পাশ্রমে থাকতেন তিনি। বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা কাজলবাবু মানভূমের বঙ্গভুক্তির দাবিতে ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল পুঞ্চার পাকবিড়রা থেকে কলকাতা যে পদযাত্রা হয়েছিল,
সেই পদযাত্রার প্রথম দলের অধিনায়ক ছিলেন।
তিনি জানালেন, ” প্রচন্ড গরম। চটি কেনার টাকা নেই যে সব প্রান্তিক মানুষের কাছে, তারা খালি পায়ে এতটা পথ মানুষ হাঁটবেন কীভাবে? মানভূম জননী লাবণ্যপ্রভা ঘোষের কথায় কলকাতার মেটিয়াবুরুজ থেকে ৫০ পয়সা করে ২০০ জোড়া টায়ারের জুতো নিয়ে এসেছিলাম। সেই জুতো দেওয়া হয়েছিল সেনানীদের পায়ে। টায়ারের ওই জুতো পায়ে গলিয়ে হয়েছিল পদযাত্রা।”

ভারতের মধ্যে প্রথম মাতৃভাষার রক্ষার জন্য আন্দোলন ছিল মানভূমের ভাষা আন্দোলন। ১৯১২ সালে আন্দোলনের সূচনা। ১৯৩৬ সালে বিহার থেকে উড়িষ্যা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর বিহার বুঝতে পারে সাবেক মানভূমকে আর বেশিদিন বিহারে ধরে রাখা যাবে না। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক স্কুলগুলিতে হিন্দি ভাষা জোর করে চাপানোর প্রবল চেষ্টা শুরু হয় সাবেক মানভূমে। এরপর এই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মানভূমে। রাতারাতি ২৫০ নতুন হিন্দি প্রাথমিক স্কুল গজিয়ে ওঠে। আদালতে কাজকর্ম শুরু হয় হিন্দিতে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল। বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে ৯ বছর ধরে চলে ভাষা সত্যাগ্রহ। যার অন্যতম অধ্যায় ছিল টুসু সত্যাগ্রহ। মানভূমের জনপ্রিয়
লোকগানকে ভাষা আন্দোলনে ব্যবহার করা হয়েছিল। ” শুন বিহারী ভাই /
তোরা রাখতে নারবি ডাঙ দেখাই।/ তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি / বাংলা ভাষায় দিলি ছাই।/ ভাইকে ভুলে করলি বড় /বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই। “

২০ এপ্রিল থেকে ৬ই মে পর্যন্ত দীর্ঘ পদযাত্রা। আন্দোলনকারীদের ৭ই মে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৩ দিন পরে মুক্তি। কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে এক বিশাল জনসভায় আন্দোলনকারীদের জানানো হয় অভিনন্দন । ২০ মে স্পেশাল ট্রেনে তাঁরা পুরুলিয়া ফিরে আসেন।
তারপর আসে বহু কাঙ্ক্ষিত পয়লা নভেম্বর। খণ্ডিত মানভূম পুরুলিয়া নাম নিয়ে যুক্ত হলো বাংলায়৷ আর বঞ্চনার অশ্রু তার চোখ থেকে মুছতে পারল না বঙ্গভুক্তির ৬৯ বছরও।

Post Comment