নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া :
দীর্ঘদিনের ট্র্যাডিশন ভেঙে এপ্রিল মাসের তীব্র গরমে পুরুলিয়ায়
মর্নিং থেকে ডে হয়েছে প্রাথমিক স্কুলগুলি। ৪০ডিগ্রি সেলসিয়াসের রুদ্র রূপে ক্লাসরুমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে পড়ুয়ারা। ইতিমধ্যেই শিক্ষা দপ্তরের অমানবিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। পুনরায় মর্নিং সেশনে পঠন পাঠন শুরু করার দাবি তুলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদে ডেপুটেশন দিয়েছে উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। আর তার মধ্যেই অভিভাবকদের মধ্যেও ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে তুলছে তীব্র দাবদাহে স্কুলে স্কুলে পড়ুয়াদের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা।

মঙ্গলবার স্কুল চলাকালীন বাংলার উষ্ণতম জেলায় তিন পড়ুয়া অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর মিলেছে। এক পড়ুয়াকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছে। তাপপ্রবাহের কারণেই এমন হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ ।
রাজ্যের নির্দেশ মোতাবেক মর্নিং সেশনে পঠন পাঠন চালানোর বিজ্ঞপ্তি পালটে ডে সেশনে পঠন পাঠন শুরু করার নির্দেশ দিয়ে তাপপ্রবাহের কারণে একের পর এক ছাত্র-ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় চাপে পড়ে গিয়েছে পুরুলিয়া জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ। সংসদের চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক রাজীবলোচন সরেন বলেন, ” ঘটনার কথা শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে রিপোর্টও করেছি। এরপর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবেন।”

অভিযোগ উঠছে, জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদগুলি স্বশাসিত হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। পর্ষদের নির্দেশে এবার প্রথা ভেঙে প্রথম রাজ্যের উষ্ণতম জেলায় এপ্রিল মাসে মর্নিং সেশনের বদলে ডে স্কুল চলছে বলে জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ সূত্রে জানা গিয়েছে।
বাম আমল থেকেই রাজ্যের উষ্ণতম জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরে এপ্রিল, মে, জুন মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে মর্নিং সেশনে স্কুল চলার ট্র্যাডিশন বহাল ছিল। রাজ্যে পালাবদলের পরেও গত বছর পর্যন্ত স্ব-শাসিত জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের আদেশনামা মেনেই
তিন মাস মর্নিং স্কুল হয়। সেই ট্র্যাডিশন মেনে চলতি বছরের ২৬ মার্চ পুরুলিয়া জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছিল ২ এপ্রিল থেকে মর্নিং স্কুল হবে। শুরু হয়েও যায় মর্নিং স্কুল। কিন্তু হঠাৎ করে পুরুলিয়ায় ৪ এপ্রিল আবার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ জানায় ৭ এপ্রিল সোমবার থেকে ফের হবে ডে স্কুল। এই পরিবর্তিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শিক্ষক সংগঠন পথে নামে। স্মারকলিপিও প্রদান করে। কিন্তু ওই বিজ্ঞপ্তির আর বদল হয়নি।

এদিন সাঁতুড়ি ব্লকের ওই চক্রের ধনেশডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র সত্যজিৎ বাউরি হঠাৎ করেই ক্লাসের মধ্যে অসুস্থ হয়ে যায় । দেখা যায় তার গায়ে জ্বর। সে জানায়, মাথা ঘুরছে, ঝিমুনি ভাব আসছে। সঙ্গে প্রচন্ড মাথা ব্যথা ও বমি। ওই অসুস্থতায় ঘাবড়ে যান শিক্ষকরা। স্কুলেই চলে তার প্রাথমিক চিকিৎসা। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকাশ পাল বলেন, ” আমরা কোনোভাবে সামাল দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার মধ্য দিয়ে ওই ছাত্রকে সুস্থ করে তুলি। তারপর তার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। আমরা স্কুলের তরফে অবর বিদ্যালয় পরিদর্শককে বিস্তারিত রিপোর্ট করেছি। ” একইভাবে এই ব্লকের এই চক্রের বাটকা প্রাথমিক বিদ্যালয়েও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র রাজীব সরেন স্কুলের মধ্যেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মলয়জ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “কয়েকদিন ধরে সকাল দশটার পরে যে হিট ওয়েভ শুরু হয়েছে তাতে রোদে বার হওয়া যাচ্ছে না। আমরা সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বলে দিয়েছি জল খেতে বাইরে বার হতে হবে না। সেই জন্য আমরা জলটা ক্লাসরুমের পাশেই রেখেছি। তবে মিড-ডে মিল খেতে গিয়েই সমস্যা হচ্ছে। ছাত্রটি যেভাবে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল তাতে আমরা ভীষণই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। ওয়ারেশ খাওয়ানোর পর তাকে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। ” একইভাবে পুরুলিয়া দু’নম্বর ব্লকের আড়তা প্রাথমিক স্কুলেও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী শ্রীতমা মাহাতোর ক্লাস রুমের ভেতরেই নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত বার হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকরা তার প্রাথমিক চিকিৎসা করে তার পরিবারকে জানায়। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মধুসূদন মাহাতো বলেন, ” প্রচন্ড গরমের জন্য এমন হয়েছে। আমরা ঘটনার পরেই তাকে প্রাথমিকভাবে সুস্থ করে তার
বাড়িতে খবর দিয়েছিলাম। বিষয়টি যথাস্থানে জানিয়েছি। ” উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সহ-সভাপতি চন্দন চট্টোপাধ্যায় বলেন,” আমরা গত শনিবার পুরুলিয়া জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে এই সিদ্ধান্ত বদলের দাবি জানিয়েছিলাম। সোমবার আমরা তাঁর কাছে
স্মারকলিপি প্রদান করেছি। কিন্তু সিদ্ধান্তের কোন বদল হয়নি। এইরকম অসুস্থতার ঘটনা ঘটতেই থাকবে। যদি না মর্নিং স্কুল হয়। আমাদের দাবি অতীতের ধারা মেনে এপ্রিলে প্রাথমিক স্তরে মর্নিং স্কুল হোক। ” পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জেলা সাধারণ সম্পাদক সুধন্যা মাহাতো বলেন, “আমরা পুরুলিয়া জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছি অবিলম্বে মর্নিং স্কুল করা হোক। কারণ এটাই পশ্চিমাঞ্চলের জেলায় দীর্ঘদিনের ট্রাডিশন।”
পুরুলিয়ায় গত কয়েক দিন ঝড়-বৃষ্টিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা খানিকটা নামলেও এপ্রিলের শুরু থেকেই এই জেলায় আবার সূয্যিমামা রুদ্র রূপ দেখাতে শুরু করেছে। ৪০ ডিগ্রিতে ঘোরাফেরা করছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। সঙ্গে বেলা এগারোটার পর থেকেই শুকনো গরম হাওয়া বইছে। মঙ্গলবার পুরুলিয়ার সর্বোচ্চ ছিল ৩৯.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।











Post Comment