সুজয় দত্ত :
লড়াইটা সেদিনও ছিল, আজও আছে। রাজনৈতিক দূষণ থেকে মুক্তির লড়াই। সৃজন উৎসবের তিরিশ বছর পার করেও সে লড়াই একইরকম। বলছেন জঙ্গলমহল পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র, বিশিষ্ট সাহিত্যিক তথা সৃজন উৎসবের প্রাণপুরুষ সৈকত রক্ষিত। শিল্পের মেশামেশি নিয়ে জীবনের মহা সংগমের যে স্বপ্ন তিনি লালন করেছিলেন তিরিশ বছর আগে সৃজন উৎসবের মাধ্যমে, আজও সেই স্বপ্ন সমান প্রাসঙ্গিক।
‘টটকো ডাকে আয় কুমারী ডাকে আয়/ খড়িদুয়ারা ডুংরি মাতে সৃজন উৎসবে।’ প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের এই গান আজও ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তোলে কুমারী টটকোর সংগমে। মানবাজার থেকে ১০ কিমি দক্ষিণে মানবাজার ২ নং ব্লক এলাকার খড়িদুয়ারা ডুংরি। সৃজন উৎসবের পৃষ্ঠভূমি হিসেবে এখন ভারত বিখ্যাত। প্রথম দিকে কোজাগরীর চাঁদ গায়ে মেখে সৃজনভূমি স্নাত হলেও গত কয়েক বছর চাঁদ পাল্টেছে সে। রাস পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় উৎসব প্রাঙ্গণ। ডুংরির চূড়ায় চূড়ায় ভিন্ন নাম তখন।
মহেন্দ্র শিল্পপীঠ, চিত্রকূট শিল্পপীঠ ও কিষ্কিন্ধ্যা শিল্পপীঠ। বাউল আখড়ার নাম রাসমঞ্চ। বাংলায় ভারতমেলার আয়োজনে হাজার শিল্পীর লক্ষ সংগম। শহর ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অদ্ভুত মেল বন্ধন। আগে দুদিনের উৎসব এখন বছর কয়েক ধরে নিজের পরিধি বাড়িয়ে নিয়েছে। এখন মেলা চলে তিনদিন। এবার তিরিশতম বর্ষের মেলা শুরু হয়েছিল ১৫ নভেম্বর রাস পূর্ণিমার দিন। শেষ হলো ১৭ নভেম্বর রবিবার। বান্দোয়ান-মানবাজার রাস্তার খড়িদুয়ারার টিলা হয়ে উঠেছিল সৃজনডুংরি নামেই খ্যাত। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা তো বটেই, ভিন রাজ্যের একাধিক সাংস্কৃতিক দলও এখানে এসেছে। লীলা কীর্তন, বাউল, ঝুমুর নাচের সঙ্গে ছিল বিভিন্ন রাজ্যের লোকনৃত্য। মূলত অবলুপ্তির হাত থেকে দেশজ সংস্কৃতিকে রক্ষা করতেই এই উৎসব। কেরলের কথাকলি আর মানভূমের ছৌ যেন শিল্পের টানে মাটির গন্ধে হাজির একাসনে।
“শিল্প ও শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি ভিন রাজ্যের লোক সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটানোর যে লক্ষ্য নিয়ে সৃজন উৎসবের সূচনা হয়েছিল তিরিশ বছর আগে, সেই লক্ষ্য থেকে আমরা সরিনি বলে উৎসব আয়োজনের খিদে সেই একই রকম আছে।” বলছেন সৈকত রক্ষিত। তিনি বললেন, “যে কোন অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষকে দিয়ে উদ্বোধন না করালে যেন সেই অনুষ্ঠান সম্পূর্ণতা পায় না। সে তাঁর সেই উৎসবের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহ, জ্ঞান না থাকলেও। এই রাজনৈতিক দূষণ থেকে সৃজনভূমিকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চলছে আজও।” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের মতো খ্যাতনামা সাহিত্যিক সৃজন উৎসবের উদ্বোধন করেছেন। তাঁরা কিন্তু সংস্কৃতি জগতের ব্যক্তিত্ব। এবার যেমন ব্যক্তি নয়, লোকবাদ্যের ঐকতান উদ্বোধন করেছিল মেলা। এই তিরিশ বছরে তার চরিত্র বিন্দুমাত্র হারায়নি সৃজন মেলা। গ্ল্যামার বেড়েছে। আর তার সঙ্গে বেড়েছে দায়িত্ব। বলছেন সৈকত রক্ষিত। “সৃজনভূমির মাথায় তখন রাসপূর্ণিমার রুপোলি চাঁদ শবর শিশুর মতো হামাগুড়ি দিচ্ছে। শীতের হাওয়ায় মৃদু কাঁপন নিয়ে ঝলমল করছে বনজঙ্গল। ঠিক তখনি পাতার আড়ালে শাখায় শাখায় ডানাগুটিয়ে বসে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন পাখিদেরও সচিকত করলো এক ছোট্ট বংশীবাদকের সুর। সৃজিতা সেন। স্মরণ করলো কৃষ্ণকে আর মোহিত করলো সারা সৃজনভূমির অগণিত দর্শনার্থীদের।” লোকায়ত সংস্কৃতির দর্পণের মতো টটকো কুমারীর সংগমে যেন প্রতিফলন ঘটছে সৃজন চন্দ্রের।
তথ্য সহায়তা : অমরেশ দত্ত, মানবাজার
Post Comment