নিজস্ব প্রতিনিধি, হুড়া :
বাইক ধরা ভূতের আতঙ্কে কাঁটা অর্জুনজোড়া সহ একের পর এক গ্রামের মানুষ।
দিন হোক বা রাত। বাইক পার হলেই কে যেন থামিয়ে দিচ্ছে বাইক। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্টার্ট। চালকের মনে হচ্ছে কে যেন সজোরে জাপটে ধরছে সর্বাঙ্গ। আর মুহূর্তে খিমচে দেওয়ার দাগ হয়ে যাচ্ছে শরীরে। যেন ধারালো নখ দিয়ে ‘নুচে’ দিয়ে গেলো কেউ।
দু’সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এমন অশরীরীর অশৈলী কাণ্ডের সম্মুখীন নাকি হয়েছেন প্রায় ৩-৪ জন। আর লোকমুখে তাতে ধরেছে দেদার রঙ। ভূতের আতঙ্ক চেপে বসেছে পুরুলিয়ার হুড়া থানার অর্জুনজোড়া সহ বিস্তীর্ণ এলাকায়। ঠিক জায়গাটা কোথায় জানেন? অর্জুনজোড়া – কেশরগড় যাওয়ার রাস্তায়,
অর্জুনজোড়া থেকে এক কিমি দূরে জঙ্গল রাস্তায়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে আতঙ্কের সূত্রপাত তিন সপ্তাহ আগে। ঠিক ওই এলাকাতেই জঙ্গলে এক ১৭ বছরের কিশোরের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আর তার তিন-চার দিন পর থেকেই ঘটে চলেছে হাড় হিম করে দেওয়া অস্বাভাবিক ঘটনাগুলি।
আতঙ্কের গ্রাসে অর্জুনজোড়া প্রাথমিক থেকে হাইস্কুলেও ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির সংখ্যা কমে এসেছে। স্থানীয় একটি বেসরকারি স্কুলের হোস্টেল প্রায় ছাত্রশূন্য। বিকালের পর তো দূর অস্ত। দিনের বেলাতেও ওই পথ দিয়ে যাচ্ছেন না ওই এলাকার মানুষজন। ভূত আতঙ্কে ঘুরপথে যাতায়াত চলছে তাদের। যারা এমন অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন তারা এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যে ওঝা, গুরুবাবার দ্বারস্থ হয়েছেন।

সব থেকে আগে অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী অর্জুনজোড়া গ্রামের বাসিন্দা জলধর গরাঁই। তিনি বলেন, ” দিন সাতেক আগে বিকাল তিনটা নাগাদ ওই রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ ওই জায়গাতে আমার বাইক বন্ধ হয়ে যায়। স্টার্ট দিতে গেলেও কিছুতেই স্টার্ট হচ্ছিল না। তার মধ্যে কে যেন জড়িয়ে ধরল আমাকে। কিন্তু তাকে আমি চোখে দেখতে পাইনি। কেবল দেখলাম সারা শরীরে আঁচড়ের দাগ। তারপর থেকে আমার শরীরটা ঠিক ভালো যাচ্ছে না। গোটা বিষয়টা গ্রামবাসীদের জানিয়েছি জানিয়েছি। “
ওই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আতঙ্ক কাটাতে ঝালদায় গুরুবাবার কাছে গিয়ে ঝাড়ফুঁক করিয়ে আসেন। তারপর আর তিনি কোন ভূত দেখেননি বলে দাবি। তবে আতঙ্কে ওই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করা বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। জানালেন তার পরিবারের সদস্যরা।
কেউ দেখেনি ভূত? নাকি দেখেছে কয়েকজন ‘ছুটু ছ্যেল্যা’? সারা গা নাকি কালো লোমে ঢাকা তার। বনের দিকে আর তারা পা বাড়াচ্ছে না।
দিনের পর দিন ওই এলাকায় অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হওয়া মানুষজনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কেউ চোখে দেখেনি। অনুভব করেছে কোন একজনের উপস্থিতি। তারা এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যে ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে কান্নাকাটির রোল। আতঙ্কের মাঝেও গ্রাম্য হাসি মস্করা বাদ থাকছে না।
শুধু অর্জুনজোড়া গ্রাম নয়। লাগোয়া জজডি, কুদলং, বাঘাটাড়, রামডিতেও ভূতের আতংক চেপে বসেছে। দিনের পর দিন পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে বাজার-হাট যেতে ভয় পাচ্ছেন গ্রামের মানুষজন। জঙ্গলে শুকনো পাতা সংগ্রহ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন। তারাও ভয়ে জঙ্গলে যেতে পারছেন না। প্রত্যেকের মনে একটাই আতঙ্ক চেপে বসেছে-‘বাইক ধরা ভূত’!

আর এই ভূতের দর্শন দেওয়াতে পারলেই ৫ লক্ষ টাকা ইনাম ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ-র পুরুলিয়া জেলা কমিটি। বুধবার তাদের প্রতিনিধি দল ওই গ্রামে গিয়ে এই পুরস্কারের কথা জানায়। দলে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ পুরুলিয়া জেলা কমিটির তিন প্রতিনিধি। গ্রামে গিয়ে তাঁরা বোঝান এরকম ভূত বলে কোন কিছু নেই। কিন্তু তাতে গ্রামের মানুষজন বিশ্বাস করলে তো! বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা ওই গ্রামে জানিয়ে এসেছেন, এই ভূতের গুজব যারা রটাবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আপাতত ওই পথে ভূতের ভয় কাটাতে হুড়া থানা থেকে দুই সিভিক ভলান্টিয়ারকে পাহারায় রাখা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা গ্রামের মানুষজনকে গিয়ে বুঝিয়েছি। এইসব ভূত-প্রেত বলে কিছু হয় না। যারা ভূতের গুজব ছড়াবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে আমরা ঘোষণা করেছি বাইক ধরা ভূত দেখাতে পারলে ৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।”
আতঙ্ক ঘোচাতে বিজ্ঞান মঞ্চ এলাকায় রাত্রি জাগরণের পরিকল্পনা নিয়েছে।
Post Comment