insta logo
Loading ...
×

সময়ের মুহূর্তকে থমকে চলে গেলেন সন্তু

সময়ের মুহূর্তকে থমকে চলে গেলেন সন্তু

সুজয় দত্ত,পুরুলিয়া :

মানবজমিন যাঁর বিখ্যাত উপন্যাস সেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ৯০ তম জন্মবার্ষিকী পার হলো দুদিনও হয়নি, আর যাঁর জীবন ও কর্মকে নিয়ে বানানো তথ্যচিত্রের নাম নির্মাতা তথা প্রখ্যাত আলোকচিত্রী স্বরূপ দত্ত দিয়েছিলেন ‘মানব জীবন’ সেই সন্তোষ রাজগড়িয়া চলে গেলেন আজ। অবশ্য যাবেনই বা কোথায় পুরুলিয়ার মাঠঘাট, টাঁড়টিকর তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। আর সে অমরত্ব তিনি তাচ্ছিল্যও করতে পারেননি। স্বনামধন্য আলোকচিত্রী সন্তোষ বাবুর জন্ম ১৯৫৩ সালের ৯ আগস্ট। পুরুলিয়া জগন্নাথ কিশোর কলেজ থেকে কলা বিভাগে স্নাতক। তারপর যুক্ত হন পারিবারিক ব্যবসায়। সে ব্যবসাও পুরুলিয়ার জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। মোহন সুইটস, মোহন সেলুলার, মোহন ইলেকট্রনিকস…। সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকেও যেমন সিদ্ধার্থর মধ্যে লুকিয়ে ছিল বুদ্ধ, ঠিক তেমনই সন্তুবাবুর কবি মন, বাউল হৃদয়কে ঠিক চিনে নিয়েছিল পুরুলিয়ার প্রকৃতি। ক্যামেরাকে আশ্চর্য বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে বশ করেছিলেন তিনি। আর হয়তো একটা মুহূর্তকে বন্দি করতে শুয়ে থাকতেন শুকনো মাঠে, প্রহরের পর প্রহর। ২০০৩ সালে ‘গুরু’ সন্তোষ রাজগড়িয়ার জীবন ও কর্ম নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন পুরুলিয়ার আরেক কৃতি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আলোকচিত্রী স্বরূপ দত্ত। তিনি বলেন, “আজ দ্বিতীয় বার পিতৃহারা হলাম। ” প্রাবন্ধিক ড. দয়াময় রায় বলেন, “সন্তোষ বাবু ফটোগ্রাফির জগতে পা রেখেছিলেন ১৯৭২ সালে একশো কুড়ি এমএম ক্যামেরা দিয়ে। তাঁর এই সুদীর্ঘ পথ চলায় উনি ছবি তুলেছেন তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। আসলে ওঁর হৃদয়ের ভিতরে ছবিগুলি আঁকা ছিল বলেই তা তুলতে পেরেছেন এমন জীবন্ত ভাবে। তিনি পুরুলিয়ার গ্রামীণ জনপদের, জীবনের, লোকাচারের, লোকসংস্কৃতির এক ধ্রুপদী ফটোগ্রাফার।
পুরুলিয়াকে চিনতে হলে তার ছবি দিয়েই চেনা যায়। তাঁর জীবন সাধনায় অদ্যাবধি ২৫০টি জাতীয়, আন্তর্জাতিক স্তরের সম্মাননা প্রাপ্তি ঘটে। এই তথ্যই বলে দেয় তিনি কোন মার্গের ফটোগ্রাফার ছিলেন।
আশাবরী প্রকাশনা তার গুরুত্বপূর্ণ ফটোগ্রাফির সুগ্রন্থিত চিত্রগ্রন্থ ‘ মোমেন্টস ইন টাইম ফটোগ্রাফি অফ সন্তোষ রাজগড়িয়া। ” এই চিত্রগ্রন্থে প্রকাশক বলেছেন, সন্তোষ রাজগড়িয়া কোন পুরস্কার পাননি, বরং বলা যায় পুরস্কার তাঁর ওপর বর্ষিত হয়েছে।
১৯৮৬, ১৯৯০ ও ১৯৯১ এ জাপান থেকে পেয়েছেন ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৮৯ ও ৯০ সালে পরপর দুবার তাঁকে পুরস্কৃত করেছে জাপানের অলিম্পাস ইন্টারন্যাশনাল ফটো কনটেস্ট। জাপান থেকেই পেয়েছেন তিন তিনবার নিকন ফটো কনটেস্ট ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার। তাইওয়ান থেকে তাইপেই ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৮১,১৯৮৩ ও ২০০৫ সালে।স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন ইস্তাম্বুল ও আমেরিকার সংস্থা দ্বারা। ভারত সরকার তাঁকে তিনবার প্রদান করেছে ন্যাশনাল ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র সৈকত রক্ষিত ২০২৩ সালে প্রকাশিত মোমেন্টস ইন টাইম ছবির বই প্রসঙ্গে বলেছেন, ” শ্যুটিং দেখে যেমন মুভির কোয়ালিটি বোঝা যায় না, ঠিক তেমনি সন্তোষের ছবি তোলা দেখেও বুঝতে পারা যায় না কত সহজপ্রাপ্য জিনিসকে ছবিতে তিনি মাহাত্ম্য আরোপ করে চিরকালীন করে তোলেন। শিল্পের বিচারে কালের পরিপ্রেক্ষিতে যাকে নিছক ‘ফোটোগ্রাফি’ বললে কমই বলা হয়। আসলে যা Reflection of culture.
… আমাদের জীবনের এই খণ্ডিত মুহূর্তগুলিও যে খণ্ডিত নয়, বরং তারা পূর্ণতার কথা বলে, তা সন্তোষের ছবি দেখলেই বোঝা যায়।… প্রাত্যহিক দৈন্য ও বিষাদ নিয়ে, আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ও স্বপ্ন-ছোঁয়ার বাসনা নিয়ে, তাঁর ছবিগুলি–যা কখনও কখনও পেন্টিংস বলেও ভ্রম হয়ে থাকে—জীবনের সব অশ্রু ও অন্ধকার অতিক্রম করে নিত্যকার জীবনচরিত ও স্বপ্নময় অনিত্য জীবনের চিরায়ত ভালোবাসারই লোককীর্তন করে, যা শিল্পের শেষকথা বলেও মনে করি। এবং যার প্রতিধ্বনি উঠে আসে তাঁর ভাবনাতেও, ‘If a Photographer can tell a story, sing a song, recite a poem or convey a feeling or an emotion only then it is an art.’ ” বাস্তবিক এভাবেই সন্তোষ রাজগড়িয়ার ছবি হয়ে উঠেছে রাঢ়বঙ্গের জীবন্ত আর্কাইভ।

ছবি :মহাদেব লাল বারাই ও স্বরূপ দত্ত

Post Comment