সুজয় দত্ত ও বিশ্বজিৎ সিং সর্দার :
চান্ডিলের বালিডি সহ ১০ গ্রামে বন দপ্তর জারি করেছে ১৮৯(৪)। জিনাতের টানে আসা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অবস্থান ঠিক কোথায় তা বুঝতে তার দ্বিতীয় হত্যার অপেক্ষায় ঝাড়খণ্ড বন বিভাগ। জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম তো বটেই, আতঙ্ক ছড়িয়েছে চান্ডিল শহরেও।
রাত দশটা পর্যন্ত যে চান্ডিল বাজারে দোকানপাট খোলা থাকত। সেই চান্ডিল এখন রাত আটটাতেই শুনশান। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আতঙ্ক শুধু বালিডি জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে নয়। চৌকা সদর থেকে চান্ডিল শহরে এমন ভাবে চেপে বসেছে যে ড্যাম লাগোয়া এলাকায় এই শীতের মরশুমেও সেভাবে পিকনিক পার্টি আসছে না। চান্ডিল শহর লাগোয়া ড্যামের পাশে গাঙ্গুডি, পুনর্বাস, ভালুককোচার মানুষজনও সন্ধ্যার পর থেকে গৃহবন্দি।
চৌকা সদরের চা বিক্রেতা নকুল চন্দ্র মন্ডল বলেন,” রাত ন’টায় চা দোকান বন্ধ করতাম। এখন সন্ধ্যে সাতটাতেই ঝাঁপ ফেলে দিচ্ছি। বাঘের আতঙ্কে কেউ বাইরে থাকছেই না। “
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আতঙ্কে চান্ডিল প্রশাসনের তরফে ১৮৯ (৪) ধারা জারি করা হয়েছে ঝাড়খন্ডের সরাইকেলা- খরসোঁওয়া জেলার চৌকা থানার বালিডি জঙ্গল সহ লাগোয়া ১০ টি গ্রামে। বালিডি গ্রামের বাসিন্দা মঙ্গল সিং মুন্ডা বলেন, ” বন দপ্তর জঙ্গলে যেতে নিষেধ করেছে। জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বিক্রি করি। তাতেই আমাদের পেট চলে। ফের কবে জঙ্গলে যেতে পারব জানি না।”
বালিডি গ্রামের বাসিন্দা দেবনাথ সিং মুন্ডা বলেন, “আমাদের গ্রামের থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত ওই জঙ্গল যেখানে বাঘ গরু মেরেছিল। “
১৮৯ (৪) ধারার আদেশনামায় বলা হয়েছে, পাঁচজনের বেশি লোক একসঙ্গে ওই জঙ্গলে যেতে পারবেন না। আতঙ্কের জেরে ৫ জন কেন, ঘোড়ালিঙ্গী, জুরগু, রাইডি, বালিডি, তুলগ্রাম, কুড়লি, খুঁটি, চৌকা, দুলমি-র বিস্তীর্ণ এলাকার একজন বাসিন্দাও আর জঙ্গলমুখো হচ্ছেন না। বনজ সম্পদ সংগ্রহ পুরোপুরি বন্ধ। গরু, বাছুর, ছাগল, মোষ থাকছে বাড়ির উঠোনে।
চৌকায় লোহা কারখানায় কাজ করেন দেবনাথ সিং মুন্ডা। তিনি বলেন, ” কারখানায় কাজ করতে যেতাম ওই জঙ্গল পথ দিয়ে। এখন ঘুর পথে যেতে হচ্ছে। সন্ধ্যার পর আর কেউ শৌচকর্ম করতেও ঘর থেকে বার হচ্ছে না।”
” জঙ্গলের পাশেই বাঘ অথচ গ্রাম জুড়ে অন্ধকার। রাস্তায় একটা আলো নেই। মুখিয়া থেকে প্রশাসন কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। ” ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন তুল গ্রামের বাসিন্দা সন্তোষকুমার মাহাতো।
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার প্রথম শিকার করার পর পার হয়ে গিয়েছে চার দিন। কিন্তু পায়ের ছাপই শুধু পেয়েছে বন দপ্তর। তাদের ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা দেয়নি জিনাতের টানে আসা আরেক রয়্যাল।
চান্ডিল রেঞ্জ আধিকারিক শশীরঞ্জন প্রকাশ বলেন, “এখনও বাঘের ছবি ট্র্যাপ ক্যামেরায় পাওয়া যায়নি। আমাদের ধারণা বালিডি জঙ্গলেই রয়েছে বাঘটি। সঠিক অবস্থান বুঝতে তার দ্বিতীয় শিকারের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি।”
এমনটা কেন? বাঘ বিশারদরা বলছেন, একটি রয়্যাল বেঙ্গল পেট ভর্তি খাবার খেয়ে ৬-৭ দিন পর আবার শিকার করে। গত মঙ্গলবার একটি গবাদি পশুকে শিকার করার পাশাপাশি বাছুর নিয়ে চলে গিয়েছিল বাঘটি। চান্ডিল রেঞ্জ কর্তৃপক্ষ মনে করছেন দু’-এক দিনের মধ্যেই ফের শিকার করতে পারে বাঘ।
সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের জিনাত ওরফে গঙ্গার গলায় রেডিও কলার ছিল। তা সত্বেও ওড়িশা, ঝাড়খন্ড ও বাংলা তিন রাজ্যের বন দপ্তরকে নাকানি চোবানি খাইয়েছিল সে। আর এই রয়্যাল বেঙ্গলের গলায় কোন রেডিও কলার নেই। প্রযুক্তির কোন সহায়তাই পাচ্ছে না ঝাড়খন্ড বন বিভাগ। ফলে চাপ বাড়ছে তাদের।জিনাতকে ধরতে ফাঁদ পাতা হয়েছিল বান্দোয়ানে। বালিডির এই ঘন অরণ্যে সেরকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ঝাড়খন্ড বনদপ্তর। কেবল ক্ষতি এড়াতে বনদপ্তরের সচেতনতার মাইকিং প্রচারে চলছে।
মঙ্গলবার বালিডির জঙ্গলে ১৩ বছরের কিশোর অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্র সুমিত মাহাতো রয়্যাল বেঙ্গলের প্রত্যক্ষদর্শী। শনিবার সন্ধ্যায় তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল চোখমুখ ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে তার। সে জানায়, ” আমি জঙ্গলে গরু চরানোর জন্য গিয়েছিলাম। সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করার জন্য পাহাড়ে যাই। পাতা সংগ্রহ করার জন্য গাছে উঠি। গাছ থেকে দেখতে পাই আমাদের গরুগুলিকে একটি বাঘ তাড়া করে নিয়ে আসছে। সে একটা গরুকে মারে এবং একটা বাছুরকে টেনে নিয়ে যায়। ওই বাছুরটি অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পর আমি গাছ থেকে নেমে সোজা বাড়ি চলে আসি। গোটা ঘটনাটা মা’কে বলি। তারপর বাড়ি থেকে বনদপ্তরে খবর দেয়। বনকর্মীরা আমাদের বাড়িতে আসেন। তারা আমাকে একটি বাঘের ছবি দেখান। আমি তাঁদের বালি হ্যাঁ, ঠিক ওই রকমই ছিল, যার হাইট আনুমানিক আমার বুক পর্যন্ত হত।”
সুমিত কুমার মাহাতোর বাবা দিলীপ কুমার মাহাতো বলেন,”এই ঘটনার পর থেকে আমাদের পরিবার সহ সমস্ত গ্রাম ভীষণভাবে আতঙ্কে রয়েছে। বাবা-দাদুদের মুখে শুনেছিলাম এই জঙ্গলে কোন এক সময় বাঘ ছিল। সেই থেকে জঙ্গলের ওই স্থানের নাম হয় বাঘধরা। কিন্তু বাঘ কোনদিন দেখিনি। আমার ছেলে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। খুবই সামনের থেকে ঘটনাটি দেখেছে। আমাদের গরু মেরেছে বাঘ। পরম সৌভাগ্য যে বাঘে আমার ছেলের কোন ক্ষতি করেনি। জঙ্গল পেরোলেই জয়দার শিব মন্দির এবং চান্ডিল শহর। চান্ডিল যাওয়ার জন্য মূল পথ হিসাবে আমরা জঙ্গলের পথকেই ব্যবহার করতাম। এই জঙ্গলকে সরকারি হলেও কোনদিন ভাবিনি এটা সরকারের। জঙ্গলকে একেবারে নিজের মনে হয়েছে। কোনদিনও জানা ছিল না, এখানে বাঘ বেরোবে।”
তিনি আরও বলেন, ” আমরা খবর দেওয়ার পর বন দপ্তরের কর্মীরা পৌঁছান। ওখান থেকে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেন। তারা বলে দেন, যাতে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির বাসিন্দাদের জঙ্গলে না যায়।”
এদিকে ঝাড়খন্ড ছুঁয়ে থাকা পুরুলিয়ার রেঞ্জগুলিতে শনিবার থেকে জলাশয়ের পাশে বাঘের পায়ের ছাপ রয়েছে কিনা তার খোঁজ চালাচ্ছে বন দপ্তর। ওই রয়্যাল বেঙ্গল জিনাতকে খুঁজতে প্রতি রাতে ১৫ কিমির বেশি হাঁটছে। এতেই উদ্বিগ্ন পুরুলিয়া বনবিভাগ। সেই কারণেই বলরামপুর, বাঘমুন্ডি বনাঞ্চলে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে তারা।
Post Comment