বিশ্বজিৎ সিং সর্দার, মাঠা ও পুরুলিয়া :
একদিকে মাঠাবুরু। অন্যদিকে পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে কেতিকার স্টুডিও। সাক্ষী থাকল পাহাড়তলির ৮৫ ফুটের ঝুলন্ত ক্যানভাস। সাক্ষী থাকল কেতিকার স্টুডিও। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ২০ জন শিল্পী। রঙ-তুলি দিয়ে সেই ক্যানভাসকে প্রাণ দিলেন। সেই রঙ-তুলিতে ফুটে উঠল এক শপথ। প্রকৃতি মাকে রক্ষা করার শপথ। নারীর মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার। প্রতি বছর পুরুলিয়ার কেতিকার একটি শিল্প সংস্থা ছবি আঁকার প্রদর্শনী ও কর্মশালা আয়োজন করেন। এবার ছিল আয়োজনের ষষ্ঠ তম বর্ষ। শিল্পীদের আয়ূধ ৮৫ ফুটের ক্যানভাস। সেই ক্যানভাস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাঠার অরণ্যে।
মানুষের লোভে কীভাবে সাফ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক অরণ্য, সেই যন্ত্রণা ফুটে উঠল শিল্পীদের তুলির টানে, বোবা ক্যানভাস হয়ে উঠল বাঙ্ময়।
শনি ও রবিবার পরপর দু’দিন প্রদর্শনী ও কর্মশালায় মাঠায় যেমন ফুটে উঠল অরণ্য বাঁচাও-র বার্তা, তেমন রবিবার কেতিকার স্টুডিওতে নারী শক্তির কথা তুলে ধরেন শিল্পীরা।
আয়োজকরা বলছেন, শুধু যে শিল্পীদের সাড়া পেয়েছেন তা নয়, পর্যটক থেকে সাধারণ মানুষজনও তাঁদের এই কর্মসূচিকে আরও রাঙিয়ে তুলেছেন।
হালকা শীতের আমেজ নিয়ে পুরুলিয়ার অরণ্যভূমি তার এক অনির্বচনীয় রূপ মেলে ধরেছে। সেই রূপকে ক্যানভাসের পিঠে রঙের জাদুতে আরও যেন রঙিন করে দিলেন শিল্পীরা। স্পষ্টতই এই দৃশ্য অভিভূত করেছে মাঠা বনাঞ্চলে আসা পর্যটকদের।
উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুর থেকে কর্মশালায় যোগ দিতে এসেছিলেন শিল্পী প্রদীপ সরকার। তিনি বলেন, “অরণ্যের প্রেক্ষাপটে আবিল হয়ে গিয়েছিল শিল্পী মন। চারিদিকে যেভাবে অরণ্য নিধন চলছে, সেই পরিস্থিতিতে এই উদ্যোগের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। “
নদীয়ার কৃষ্ণনগর থেকে এসেছিলেন অর্ক মন্ডল ও সুমিত চক্রবর্তী। পুরুলিয়ার সংগঠন সৃষ্টি বৈচিত্র আয়োজিত কর্মশালায় যোগ দিতে পেরে তাঁরা আনন্দিত। ” শিল্পী হিসেবে আমাদের যে বক্তব্য তা ক্যানভাসে তুলে ধরেছি। মানুষজন তা বুঝতে পারলে খুব ভালো লাগে। আর এই মুক্ত পরিবেশে তা বুঝতেও পারছেন মানুষ। ” বললেন শিল্পীরা।
এই কর্মশালায় অংশ নেওয়া সবচেয়ে ছোট শিল্পী দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী পুরুলিয়া জেলা স্কুল মোড়ের বাসিন্দা প্রগতি কুন্ডু বলেন, ” প্রকৃতির কোলে খোলা আকাশের নিচে এমন ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমি আমার ক্যানভাসকে প্রকৃতি মাতাকে সামনে রেখে তুলে ধরেছি। যেখানে একের পর এক জঙ্গল সাফ হয়ে যাওয়ায় প্রকৃতি মাতা ভীষণ কষ্টে রয়েছেন।”
এই কর্মশালা ও প্রদর্শনীতে কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, হুগলি, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান সেই সঙ্গে পুরুলিয়ার শিল্পীরা অংশ নেন। প্রথম দিন ২০ জন শিল্পী তাদের
ক্যানভাসকে রাঙিয়ে তুললেও দ্বিতীয় দিন স্টুডিওতে ছিলেন ৩০ জন শিল্পী।
প্রদর্শনী ও কর্মশালায় নজর কাড়েন বিশেষভাবে সক্ষম শিল্পী অনুষ্কা সুমন। তাঁর বাড়ি পুরুলিয়া শহরের শরৎ সেন কম্পাউন্ডে। খোলা আকাশের নীচে ক্যানভাসের বুকে যেমন অরণ্য বাঁচানোর বার্তা দেন এই শিল্পী, তেমনই স্টুডিওতে তুলে ধরেন নারী শক্তির লড়াইয়ের কথা। শারীরিক ভাবে ভালো করে কথা বলতে পারেন না তিনি। কিন্তু তাঁর ভাবনা, তার শিল্পকলা হয়ে উঠেছে শত জল ঝর্ণার ধ্বনি। হয়ে উঠেছে বাঙ্ময়। প্রদর্শনীর সাফল্য সেখানেই।
Post Comment