insta logo
Loading ...
×

ছড়রায় ছোট বিমানবন্দর প্রকল্পে নতুন গতি? হলো যৌথ পরিদর্শন

ছড়রায় ছোট বিমানবন্দর প্রকল্পে নতুন গতি? হলো যৌথ পরিদর্শন

নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া :

একদিকে হাইটেনশন লাইন। পশ্চিম দিকে রয়েছে রেললাইন। জমি অধিগ্রহণে রয়েছে ধোঁয়াশা। সরাতে হবে ১১ নম্বর ব্যাটেলিয়ান ক্যাম্পাস। গ্রামের যোগাযোগের জন্য করতে হবে পৃথক রাস্তা। এক কথায় যাকে বলে অবস্টাকল লিমিটেশন সারফেস। রাজনীতির ঘেরাটোপে রয়েছে কেন্দ্র রাজ্য সমন্বয় নিয়ে প্রশ্ন। এই সপ্তরথী বেষ্টিত চক্রব্যূহে ছড়রা বিমানবন্দর যেন অভিমন্যু। আর তাই আপাতত থমকে পুরুলিয়ার ছড়রায় প্রস্তাবিত ছোট বিমানবন্দর।

বৃহস্পতিবার পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে ছড়রার প্রস্তাবিত বিমানবন্দর স্থল যৌথ পরিদর্শনের উঠে এসেছে এমন তথ্যই। পরিদর্শন করলেন রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরের আধিকারিক ও প্রকল্প রূপায়ণকারী সংস্থা ‘রাইটস’-এর প্রতিনিধিরা। পরিদর্শনে ছিলেন পরিবহন, ভূমি, বিদ্যুৎ ও বনদপ্তরের কর্তারাও। হাতে ম্যাপ ও পরিমাপযন্ত্র— গোটা প্রকল্প এলাকার খুঁটিনাটি পর্যালোচনা চলে প্রায় ঘণ্টাখানেক।

পরিদর্শন শেষে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনিক ভবনে বৈঠক হয় জেলাশাসক কোন্থাম সুধীরের সভাপতিত্বে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাইটস ও এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (AAI) ইঞ্জিনিয়াররা। বৈঠকে জানানো হয়, প্রস্তাবিত রানওয়ের পশ্চিম দিকে রেললাইন থাকায় সেখানে সম্প্রসারণের সুযোগ সীমিত। ফলে পূর্ব দিকে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করা প্রয়োজন হতে পারে। তবে সেই জমি অধিগ্রহণে রাজ্য সায় দেবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত।

জেলাশাসক জানান, “যৌথভাবে পরিদর্শনের পর বৈঠক হয়েছে। যে সকল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তার দ্রুত সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।”

পাইলট প্রশিক্ষণের সম্ভাবনা

রাজ্যের পরিবহন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পস্থলেই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে ফ্লাইট ট্রেনিং অর্গানাইজেশন (FTO) গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা চলছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে পাইলট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে পুরুলিয়ায়। ফলে বিমান চলাচলের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবেও জেলার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।

‘উড়ান’ প্রকল্পের আওতায়

রিজিওনাল কানেক্টিভিটি স্কিম (RCS)-এর অধীনে কেন্দ্রের ‘উড়ান’ প্রকল্পের লক্ষ্য দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিকে আকাশপথে সংযুক্ত করা। সেই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই ছড়রায় এই ছোট বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা। বিমানবন্দরটি গড়ে উঠলে এটি হবে রাজ্যের সপ্তম বাণিজ্যিক বিমানবন্দর।

বর্তমানে প্রকল্পস্থলে প্রায় ৩০০ একর জমি রাজ্যের দখলে রয়েছে। এই জমির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের পুরোনো এয়ারস্ট্রিপটি অবস্থিত, যেখানে একসময় যুদ্ধকালীন জ্বালানি নিতে বিমান ওঠানামা করত। এখন সেই এয়ারস্ট্রিপটি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলেও মূল রানওয়ের পাশাপাশি রয়েছে একটি পিটিটি রানওয়ে।

কারিগরি প্রতিবন্ধকতা

রাইটসের প্রাথমিক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের জন্য ‘ওয়ান বি’ শ্রেণির রানওয়ে (১১০০ মিটার) তৈরি করা হবে। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে তা ১৭০০ মিটার পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। পুরো প্রকল্পে মোট প্রায় ৪১০০ মিটার জমির ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন — এর মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ৩০০০ মিটার এবং মূল রানওয়ে ১১০০ মিটার।

তবে সমস্যা রয়েছে পূর্ব দিকের হাইটেনশন বিদ্যুৎ লাইনে। রাইটসের ইঞ্জিনিয়াররা জানান, এই লাইন উচ্চতা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। অন্যদিকে পশ্চিম দিকে রেললাইন থাকায় সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। এ ছাড়াও রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের ১১ ব্যাটেলিয়নের ক্যাম্পাসটি প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের নিকটে অবস্থিত— যা সরাতে হবে বলে জানানো হয়েছে ।

নতুন পরিকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা

বিমানবন্দর চালু করতে হলে রানওয়ের পাশাপাশি দমকল কেন্দ্র, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (ATC) বিল্ডিং, ইলেকট্রিক সাব-স্টেশন, নিরাপত্তারক্ষীর ছাউনি, তিনটি ওয়াচ টাওয়ার, আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাঙ্ক ও বম্ব কুলিং পিট নির্মাণ বাধ্যতামূলক। বম্ব কুলিং পিটের মাধ্যমে সন্দেহজনক বিস্ফোরক বা বোমা নিরাপদে নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা থাকবে।

পরিকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব পূর্ত দপ্তরকে দেওয়া হয়েছে। পূর্ত দপ্তরের বাস্তুকারদের মতে, ১৯৪২ সালে নির্মিত পুরোনো রানওয়েটি ক্ষতিগ্রস্ত— বহু বছর ধরে পণ্য বোঝাই লরির চলাচলের কারণে কংক্রিট স্তর দুর্বল হয়ে গেছে। তাই নতুনভাবে রানওয়ে পুনর্নির্মাণ করতে হবে।

বর্তমানে এখানে এমন পরিকাঠামো রয়েছে যেখানে ১৯ আসনের বিমান ওঠানামা সম্ভব। তবে পর্যাপ্ত জমি ও পরিকাঠামো নিশ্চিত হলে ৪২ আসনের বিমানও সহজে নামানো যাবে বলে ইঞ্জিনিয়ারদের রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরটি চালু হলে পর্যটন, ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুরুলিয়া জেলার জন্য এটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে এটি হবে প্রথম বাণিজ্যিক বিমানবন্দর, যা ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়ের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলির যোগাযোগেও সহায়ক হবে।

এখন মূল চ্যালেঞ্জ জমি অধিগ্রহণ ও বিদ্যুৎ লাইনের উচ্চতা সংক্রান্ত অনুমোদন। প্রশাসন আশাবাদী— রাজ্য সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত মিললেই দ্রুত কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। ছড়রার আকাশে ফের বিমান ওড়ার সেই অপেক্ষাতে পুরুলিয়াবাসী।

Post Comment