সুজয় দত্ত ও বিশ্বজিৎ সিং সর্দার :
যেখানে ডেরা বেঁধেছিল রয়্যাল বেঙ্গল বাঘিনী জিনাত। সেই রাইকা পাহাড় থেকে বড় জোর ৪৫ কিমি দূরে দলমা পাহাড়। আর বালিডি জঙ্গলের বদলে জিনাতের সঙ্গী রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার এখন সেই দলমাতেই!
পার হয়ে গেছে ছ’দিন। প্রেমিকার সন্ধানে কি আসছে তার সঙ্গী রয়্যাল? চিন্তায় পুরুলিয়ার কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগ। এখানেই জিনাত
টানা ৫ দিন তাঁদের নাকানিচোবানি খাইয়েছিল। জিনাতকে খুঁজতে খুঁজতে তার সঙ্গী সোমবার কাক ভোরে ৩৩ নং জাতীয় সড়ক পার করে পাটা টোল প্লাজার খুব কাছ দিয়ে ঢুকে পড়ে দলমা পাহাড়ে। ঝাড়খন্ড বনবিভাগ জানাচ্ছে, তার পদচিহ্ন মিলেছে জাতীয় সড়কের পাশে সবজির জমিতে।
তাহলে বাংলার আশঙ্কা কোন জায়গায়?
১) মানচিত্র দেখলেই বোঝা যাবে জিনাতের অন্বেষণে তার
সঙ্গী বাঁ দিক ধরে গেলে পৌঁছে যাবে বুনো হাতির করিডর বলে পরিচিত দলমা অভয়ারণ্যে।
২) সেখান থেকে সোজা হাঁটলে পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের গভীর অরণ্য দুয়ারসিনি। এখন সেখানে জোর পর্যটনের মরশুম। ঠিক তার পাশেই য ঝাড়খণ্ডের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র গালুডি, ঘাটশিলা।
বিষয়গুলি যে বন দপ্তরকে চিন্তায় রেখেছে তা বোঝা যাচ্ছে কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগের ডিএফও পূরবী মাহাতোর কথায়। তিনি বলেন, “আশঙ্কা বাড়ছে। এই বাঘটির গলায় রেডিও কলার নেই। তাই বন বিভাগ প্রযুক্তির কোন সাহায্যই পাচ্ছে না।আমাদের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে বান্দোয়ান এলাকায়। সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে অরণ্য সংলগ্ন এলাকার মানুষজনকে।”
জিনাতের সঙ্গী বাংলায় ঢুকতে পারে আশঙ্কা করছেন স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার গঙ্গাসাগরের অনুষ্ঠান মঞ্চে তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে বাংলা সীমান্তে বাঘের আনাগোনা নিয়ে উদ্বেগ। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ একটা বাঘ ৫টা জঙ্গল, ৫টা জেলা পার হল। ৫ দিন আতঙ্কে ছিল। ছোটদের স্কুল বন্ধ ছিল। আমাদের প্রশাসন ও বনবিভাগ সকলে মিলে যে-ই আমরা উদ্ধার করলাম, ওমনি দিনরাত ফোন আসছে। ফেরত দাও। ফেরত দাও। ফেরত দাও। আর দিয়ে দিলাম।”
ওড়িশা বনদপ্তরের বিরুদ্ধে এরপর ক্ষোভ উগরে দিয়ে মমতা আরও বলেন, “আবার একটা চলে এসেছে। তোমরা তো তোমাদের জঙ্গলের খেয়াল রাখবে। যাতে তোমাদের বাঘ আমাদের এখানে না ঢুকে পড়ে। আমাদের গ্রামে আতঙ্ক না ছড়ায়। যেভাবে বনকর্মীরা বাঘ ধরেছে, তা মডেল।”
তিনি আরও বলেন, “বাঘকে পাঠালে চিরকালের জন্য পাঠাও, রেখে দিচ্ছি। তোমাদের নিজেদের রাখার জায়গা নেই। নিয়ে গিয়ে জলে ছেড়ে দিলে। এটা কী হচ্ছে! আমি ওড়িশা সরকারকে দোষারোপ না করে, অনুরোধ করব। দয়া করে বনকর্মী পাঠিয়ে বাঘকে ফেরত নিয়ে যান। শুধু আমাদের দোষারোপ করবেন না। আমাদের বাসিন্দারা ভোগান্তি সহ্য করবে না।”
বাসিন্দাদের ভোগান্তি হতে পারে সেই চিন্তায় এখন বন দপ্তরের কাছে প্রধান মাথা ব্যাথা।
ঝাড়খন্ডের সরাইখেলা-খরসোঁওয়া, তামাড়, পূর্ব সিংভূম বন বিভাগ মনে করছে পালামৌ টাইগার রিজার্ভ থেকে এই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটি আসতে পারে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কথা থেকে ইঙ্গিত যে ওড়িশা থেকে এসেছে বাঘটি।
সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে জিনাত বেরিয়ে এসেছিল। ঘর ছাড়া হওয়ার পর ঝাড়খন্ড হয়ে বাংলায় আসার পথে তার এই সঙ্গী রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের হয়তো পরিচয় হয়েছে। তাই তাকে খুঁজতেই ৬ দিন ধরে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সঙ্গী।
জিনাতকে গুলি করে ঘুমপাড়ানো শ্যুটার তথা সুন্দরবনের সজনেখালি বিট অফিসার মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, “বাঘেদের চোখে-চোখে কথা হয়। ওড়িশা-ঝাড়খন্ড-বাংলার এতো বড় বিস্তীর্ণ টানা জঙ্গল। একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। যখন জিনাত ঘর ছাড়া হয় সেই এক মাসে এই অরণ্য প্রাণ প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ দীর্ঘ জঙ্গলে কোন বাঘের সঙ্গে তার দেখা হওয়া আশ্চর্যের নয়। আর পরিচিত হওয়ার পর সেই টানে আসতেই পারে আরেক বাঘ। একদিকে ঘ্রাণ অন্যদিকে পরিচয়। এই দুই কারণে বাঘ সঙ্গীকে হাতছাড়া করতে চায় না। সুন্দরবনে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি একবার লোকালয়ে চলে আসা একটি রয়্যাল বেঙ্গলকে লঞ্চে করে বহু দূরে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে এসেছিলাম। ২১ দিন পর সে আবার নদী সাঁতরে ফিরে এসেছে। পরে জানতে পারি সেখানে তার সঙ্গীনী ছিল। ফলে জিনাতের টানে ঝাড়খন্ডে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আসা
খুবই স্বাভাবিক।”
ছোটনাগপুর মালভূমির এই এলাকা যে বাঘ থাকার আদর্শ তা মানছেন বনকর্তারা। পুরুলিয়ার ডিএফও অঞ্জন গুহ বলে, “অবাধে জঙ্গল কাটা আমরা রুখতে পেরেছি। নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি জঙ্গলের আগুনও। তাই জঙ্গল বেড়ে যাওয়ায় বন্য শূকর, হরিণ বাস করছে। ফলে খাবার, বাসস্থান সব আছে। জঙ্গলের মধ্যে আছে পাহাড়ি ঝোরাও। ফলে জল পান করার অভাব নেই। তাই এই
অঞ্চল বাঘের আবাস স্থল হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।”
Post Comment