insta logo
Loading ...
×

উচ্চ মাধ্যমিক তৃতীয় সেমেস্টারে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের জয়জয়কার — রাজ্য তালিকায় প্রথম ১০-এ ২৪ জন ছাত্র

উচ্চ মাধ্যমিক তৃতীয় সেমেস্টারে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের জয়জয়কার — রাজ্য তালিকায় প্রথম ১০-এ ২৪ জন ছাত্র

নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া :

উচ্চমাধ্যমিক তৃতীয় সেমিস্টারের ফলাফলে ফের রাজ্যজুড়ে দাপট দেখাল পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ। রাজ্যের মেধাতালিকার প্রথম দশ স্থানের মধ্যে বিদ্যাপীঠেরই একসঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে ২৪ জন ছাত্র।

রাজ্য তালিকায় ৯৮.৯৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে যুগ্মভাবে প্রথম স্থান অর্জন করেছে বিদ্যাপীঠের দুই ছাত্র — প্রীতম বল্লভ ও আদিত্য নারায়ণ জানা। প্রীতমের বাড়ি আরামবাগে, আর আদিত্যর বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরে।

বিদ্যাপীঠের আরও সাফল্য — রাজ্যের দ্বিতীয় স্থানে ৩ জন, চতুর্থ স্থানে ৪ জন, ষষ্ঠ স্থানে ৭ জন এবং নবম স্থানে ৮ জন ছাত্র রয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বামী জ্ঞানরূপানন্দ আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, “এ বছর আমাদের স্কুল থেকে ৬৪ জন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছিল। এই ফলাফল আমাদের গর্বিত করেছে। ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবক — সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল এটি।”

যুগ্ম প্রথম স্থানাধিকারী প্রীতম বল্লভ ও আদিত্য নারায়ণ জানা জানিয়েছে, “বই প্রকাশে দেরি হওয়ায় প্রথমে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু বন্ধুদের সহযোগিতা ও শিক্ষকদের নিরন্তর পরামর্শ আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।”

পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে পা রাখলেই যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করা যায়। নিস্তব্ধ, পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাসে ভেসে আসে শঙ্খধ্বনি, ঘণ্টার শব্দ, সন্ধ্যার প্রার্থনার সুর। এক অদৃশ্য নিয়ম, শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা যেন বাতাসে মিশে থাকে। ছাত্রদের মনে জাগে এক বিশেষ চেতনা — স্বামী বিবেকানন্দের বাণীকে জীবনবিধান করে তোলার প্রেরণা।

তাই তো প্রবেশপথের তোরণে লেখা — “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত”। এই মন্ত্রই যেন বিদ্যাপীঠের প্রাণ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাউন্ড সিস্টেমে ভেসে আসে — “ওঠো, জাগো, সদগুরুর সান্নিধ্যে গিয়ে জ্ঞানপ্রাপ্ত হও।” ঠাকুর রামকৃষ্ণ, মা সারদা দেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এই প্রতিষ্ঠান কেবল শিক্ষা নয়, চরিত্রগঠনেরও এক অনন্য পাঠশালা হয়ে উঠেছে।

পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে, পুরুলিয়া ২ নম্বর ব্লকের বোঙ্গাবাড়িতে অবস্থিত এই বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠা ১৯৫৮ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ছাত্রদের জন্য একটি সর্বভারতীয়, সম্পূর্ণ আবাসিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে পঞ্চম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।

শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা, শরীরচর্চা, সঙ্গীত, নাটক—সব ক্ষেত্রেই নিয়মিত অংশ নেয় ছাত্ররা। শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশই এখানকার শিক্ষার মূল লক্ষ্য। এখানকার শিক্ষার্থীরা বলছে, “বিদ্যাপীঠের পরিবেশই আমাদের সাফল্যের আসল চাবিকাঠি। শিক্ষক ও মহারাজদের পাঠ আমাদের জীবনের দিশা দেখায়।”

প্রযুক্তির যুগে তাল মেলাতে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক। বিদ্যাপীঠের প্রাক্তনীরাও আজ দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু হৃদয়ের বন্ধন এখনও এই প্রতিষ্ঠানেই গাঁথা। তাঁরা নিয়মিতই বিদ্যাপীঠকে নানাভাবে সহায়তা করে থাকেন।

ভর্তি প্রক্রিয়াও এখানে কঠোর। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য নভেম্বর মাসে প্রবেশিকা পরীক্ষা হয়। চতুর্থ শ্রেণিতে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ নম্বর পেলেই তাতে বসার সুযোগ। একাদশ শ্রেণিতে মাধ্যমিকের পর প্রবেশিকা হয়—বিজ্ঞান বিভাগে অন্তত ৯০ শতাংশ, কলা বিভাগে ৮০ শতাংশ নম্বর থাকা আবশ্যক। ফলাফল ও পরীক্ষার পারফরম্যান্স মিলিয়েই চূড়ান্তভাবে ভর্তি নেওয়া হয়।

ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মাঝে ভর্তি হবে কি না, তা নির্ভর করে বিদ্যাপীঠ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের উপর।

দশকের পর দশক ধরে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকা পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ আজও একইভাবে শিক্ষা, নীতি ও মানবিকতার মেলবন্ধনে আলোকিত করছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।

Post Comment