insta logo
Loading ...
×

উত্তরণের নব দিশায় প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন

উত্তরণের নব দিশায় প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন

অমিতাভ মিশ্র
প্রধান শিক্ষক,
গোবিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, মানবাজার ১ ব্লক
যোগাযোগ-৯৪৩৪৩০৪৮১৮
ই-মেইল-amitavamisra69@gmail.com

গোড়ার কথা

অনন্ত বৈচিত্র‍্য আর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে ছোটোনাগপুরের মালভূমি অধ‍্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক জেলা পুরুলিয়া – যেখানে প্রকৃতি রঙে রূপে রূপসী হয়ে উঠেছে। পাহাড় – নদী – বৃক্ষের অনাবিল এক স্বর্গীয় চিত্রল ভূমি এই জেলা, ছো – ঝুমুর – টুসু আর পলাশে উদ্দীপ্ত। সার্বজনীন শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক থেকে এখনো পিছিয়ে থাকা এই জেলায় শিশু শ্রম, অপুষ্টি, বাল‍্য বিবাহ, কুসংস্কার ইত‍্যাদি নানান প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অন‍্যান‍্য জেলায় স্থানান্তরিত কৃষি শ্রমিক এবং ইঁট ভাটার কর্মী হিসাবে এখানের মানুষেরা কাজ করতে যান বলে সব শিশুকে বিদ‍্যালয়ে ধরে রাখা ও গুণগত মানের শিক্ষা প্রদানের কাজটি বহুলাংশে দূরহ।

শিক্ষার অতীত অবস্থা
এই জেলার মানবাজার ১ নং ব্লকের সাঁওতাল অধ‍্যুষিত গোবিন্দপুর, শীতলট‍্যাড় ও লালাকুলিতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাস্তা, বিদ‍্যুৎ ও পানীয় জলের ব‍্যবস্থা ছিল না। নেই রাজ‍্যের বাসিন্দারা দিন মজুরী করে জীবন নির্বাহ করতেন আর তাড়ি ভাটিতে ডুবে থাকতেন। স্থানীয় মানুষদের শিক্ষার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না বলে একটি পরিত‍্যক্ত কক্ষে ছিল প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের অবস্থান। গ্রামের বটতলা ছিল অস্থায়ী স্কুল ঘর। পড়ুয়ার সংখ‍্যা ছিল খাতায় কলমে ১৮ জন। চতুর্থ শ্রেণির পরেই স্কুল ছুটের হার ছিল ৯৫ শতাংশ। বাল‍্য বিবাহ আর ডাইনী প্রথায় জর্জরিত গ্রামবাসীরা ছিলেন খানিকটা ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা।

শিক্ষার সূচনা পর্ব
২০০৬ সালে এই বিদ‍্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করার পর বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সহ গ্রামবাসীদের সাথে বারে বারে আলোচনা সভা ও পাড়া বৈঠক করে বিদ‍্যালয়ের পরিকাঠামো গড়ে তোলা সহ গ্রামোন্নয়নের নানান উদ‍্যোগ শুরু হল। গ্রামের স্বনির্ভর দলের মহিলাদের সাহায‍্যে তাড়ি ভাটি উচ্ছেদের উদ‍্যোগ নেওয়া হল। গ্রামের মানুষদের মধ‍্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র ও নৈশ বিদ‍্যালয় স্থাপিত হল। গ্রামের মানুষদের বিকল্প কাজের দিশা দেখাতে হস্ত শিশ্প, সবজী চাষ, মাশরুম সহ জৈব চাষের জন‍্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা হল। মাতৃ সচেতনতার মাধ‍্যমে ধীরে ধীরে পড়ুয়ার সংখ‍্যা হল ১৬৭ জন। স্কুল ছুটের হার হল শূন্য।

বিদ‍্যালয়ের উন্নতি সাধনে বিদ‍্যালয়ের দখলিকৃত জমি পুণরুদ্ধার করে গাছ লাগানোর পাশাপাশি সর্ব শিক্ষা মিশনের অর্থানুকূল‍্যে শ্রেণিকক্ষ, শৌচাগার সহ ছোটো ছোটো শিখনোপযোগী প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হল। প্রধান শিক্ষকের নিজের বেতনের একাংশকে ব‍্যবহার করে শিক্ষকের ঘাটতি পূরণের জন‍্য তিন জন অতিথি শিক্ষকের ব‍্যবস্থা সহ শ্রেণিকক্ষগুলিকে আর্কষনীয় করার কাজ চলতে লাগল। পর্যায়ক্রমে চারটি শ্রেণি কক্ষ ও রান্না ঘর তৈরি হল। শ্রেণি কক্ষগুলির কাজের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে ২৬০ ফুট সীমানা প্রাচীর, ভগ্নপ্রায় কক্ষটি সারিয়ে অফিস ঘর তৈরি, শিক্ষক ও অতিথিদের শৌচাগার, চাতাল, ঢালাই রাস্তা,খাবার ঘর, স্টোর রুম ইত‍্যাদি তৈরি হল। বিশিষ্ট মানুষজনদের কাছে আবেদন জানিয়ে অর্থ সহ যে সমস্ত জিনিস পত্র পাওয়া গেল তা ব‍্যবহৃত হতে লাগল নির্মল, ভীতিহীন, শিশু বান্ধব বিদ‍্যালয় তৈরির কাজে। বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত বিদ‍্যালয়ের পুরস্কার ও ব‍্যক্তিগত পুরস্কারের অর্থও ব‍্যবহৃত হল পরিকাঠামোর ঘাটতি পূরণে।
পড়ুয়াদের জন‍্য ডেস্ক সহ কার্পেট, লাইব্রেরি, বুক কর্ণার, লিঙ্ক লাইব্রেরি, নান্দনিক ডাস্টবিন, অভিযোগ ও পরামর্শ বক্স, শিশু উদ্যান, ভোজনালায় ইত‍্যাদি তৈরি হল পর্যায়ক্রমে।। কশকাতার দিব‍্যায়ন যোগ রিসার্চ সেন্টার সব পড়ুয়ার সারা বছর ধরে ব‍্যবহারের জন‍্য যাবতীয় খাতা, পেনসিল, ইরেজার ও সোয়েটার দিচ্ছেন বিনা মূল‍্যে। পিছিয়ে পড়া শিশুদের চিহ্নিত করে ছুটির দিনে রেমিডিয়াল ক্লাস চলছে ধারাবাহিক ভাবে। প্রধান শিক্ষক সহ শুভানুধ্যায়ীদের অনুদানে স্কুল ব‍্যাগ, টাই, ব‍্যাজ আর সরকারী ভাবে প্রাপ্ত পোষাক ও জুতো পরে কেতা দুরস্ত হয়ে উঠছে প্রথম প্রজন্মের আদিবাসী পড়ুয়ারা।

সহ পাঠক্রমিক কাজ
উৎপাদনাত্মক কাজের জন‍্য ফুল – ফল – সবজী – ভেষজ ও ক‍্যাকটাস উদ‍্যান তৈরি, সৃজনাত্মক কাজের জন‍্য কাপড়, পাতা, বাঁশ ও বাবুই ঘাসের কাজ, কোলাজের কাজ, সেলাইয়ের কাজ, বার্ষিক পত্রিকা ও দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ, চিত্রাঙ্কণ, ক্রীড়া ক্ষেত্রের উন্নতি সাধনে যোগ – প্রাণায়ম – ব‍্যায়াম – ড্রিল – ব্রতচারী সহ নানা ধরনের আউটডোর ও ইন্ডোর গেমের জিনিস পত্রের ব্যবস্থা এবং সক্রিয় শিশু সংসদ গঠন করে বিদ‍্যালয় পরিচালনায় ভিন্নতর ভাবধারা রূপায়িত হতে লাগল। সম্পৃর্ণরূপে পড়ুয়াদের দ্বারা পরিচালিত গান, নাচ, লোক নৃত‍্য, ছোনাচ, ছড়ার মাধ‍্যমে শারীরিক কসরত ইত‍্যাদির সমন্বয়ে এক ঘন্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ঘোষক হিসাবেও অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে পড়ুয়ারা। সচেতনতামূলক নাটক সহ বিভিন্ন দিবস উদযাপনের জন‍্য মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের রূপরেখাও তৈরি করছে শিশু সংসদ। সব পড়ুয়ার জন্ম দিন পালনে শিশু সংসদ আয়োজিত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হচ্ছে সুশৃঙ্খল ভাবে। এই কাজগুলিকে উৎসাহিত করতে শুভানুধ‍্যায়ীর অনুদানে একটি মুক্তমঞ্চ তৈরি হয়েছে। মাইকের সাহায‍্যে প্রার্থনার সময় জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হলে গ্রামের মানুষ ঐ সময় সব কাজ বন্ধ রাখছেন – যা গ্রামবাসীদের মধ্যে জাতীয় সংহতিকে দৃঢ় করছে।

আধুনিক শিক্ষা দানে
নিয়মিত ভাবে স্মার্ট প্যানেল বোর্ড ও প্রোজেক্টরের সাহায‍্যে এবং মেটাভার্স পদ্ধতিতে দৃশ‍্য – শ্রাব‍্য পাঠদান, কম্পিউটার,রেডিও, টি, ভি, মোবাইল এবং টেলিস্কোপের মাধ‍্যমে পাঠদান, স্লাইড শো, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, ডিজিট‍্যাল পেন দিয়ে ডিজিটাল ক‍্যালেন্ডার ও বই ব্যবহার করে পাঠদান, স্টোরি উইভার, চক্র চার্ট – বোর্ড চার্ট – পকেট বোর্ডের ব‍্যবহার, নেচার স্টাডি ইত‍্যাদির মাধ‍্যমে আই. সি. টি. লার্নিং প্রোসেস অনুসৃত হচ্ছে। আনন্দদায়ক পাঠদানের জন‍্য পিয়ার লার্নিং, গ্রুপ লার্নিং, শিক্ষামূলক ভ্রমণ, সরকারী দপ্তরের কাজ পরিদর্শন, আলোচনা চক্র, বিতর্ক, ক‍্যুইজ, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, গল্পের ছলে পাঠদান, খেলার মাধ‍্যমে পাঠদান, গণিত ও ভাষা উৎসব, বিজ্ঞানের মডেল তৈরি, নাট‍্যাভিনয়ের মাধ‍্যমে পাঠদান, প্রদর্শনী ইত‍্যাদি সম্পাদিত হচ্ছে। সমবায়, আমাদের দোকান, ডল ব‍্যাঙ্ক, টি. এল. এম. ব‍্যাঙ্ক , পাতা কুড়িয়ে গুনতে বলা, মাটির তৈরি নানান শিক্ষাপোকরণের ব‍্যবহার এবং ফেলে দেওয়া জিনিস পত্র দিয়ে স্বল্প ও বিনামূল‍্যে টি. এল. এম. তৈরি করতে শিখছে পড়ুয়ারা। মেঠো ইঁদুর ধরা হাত আজ মাউস ধরতে অভ্যস্থ হচ্ছে।

নান্দনিক পরিবেশ রচনায়
গোটা বিদ‍্যালয় চত্তরকে টি. এল. এম. হিসাবে ব‍্যবহার করার জন‍্য বিদ‍্যালয় ভবন, শ্রেণিকক্ষ, বারান্দা, সিঁড়ি, মেঝে, গ্রীল, সীমানা প্রাচীর সাজানো হয়েছে সহজ পাঠের ম‍্যুরাল আর্ট, ছবি, কার্টুন, মনীষীদের আবক্ষ মূর্তি, ছবি ও বাণী, ছো নাচের মুখোসের ম‍্যুরাল আর্ট, যামিণী রায়ের ছবির ম‍্যুরাল আর্ট, মাদল ও ধমসা বাদকের মূর্তি, হাতি – ঘোড়া – বাঘ – বক – হাঁস ইত‍্যাদির স্ট‍্যাচু এবং স্থানীয় সংস্কৃতির মডেল দিয়ে। মানব সভ্যতার বিবর্তন বোঝাতে বিদ্যালয় ভবনে ২৭ টি প্লেট বসানো, বাগানের মাঝে গ্লোব তৈরি, বৃক্ষ পরিচিতি বোর্ড, পাখিরালয়, মৎস‍্যালয়, পদ্ম পুকুর, পড়ুয়াদের হাতের কাজের সংগ্রহশালা, চিত্র প্রদর্শনী, নান্দনিক বেসিন ও ডাস্টবিন, দৈনন্দিন খবর লেখার বোর্ড, জুতা রাখার র‍্যাক, দোলনা – স্লিপার – সী – স, সাইড সুইং সহ কিডস জোন তৈরি নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করে পড়ুয়াদের মধ‍্যে বিদ‍্যালয়ের প্রতি আসক্তি তৈরি করা হচ্ছে।

নির্মল পরিবেশের লক্ষ‍্যে
বিদ‍্যালয় ও গ্রামে নিয়মিত শৌচাগার ব‍্যবহার, খাবার আগে ও শৌচের পরে পাঁচটি ধাপ মেনে হাত ধোয়া শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকেই। সকলের জন‍্য আধুনিক মানের শৌচাগারের ব‍্যবস্থা, শৌচাগার ব‍্যবহারে আকৃষ্ট করতে দরজার বাইরে কার্টূন অঙ্কন, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন‍্য প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে টিম তৈরি, পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ‍্য নিষ্কাষনের জন‍্য পৃথক পৃথক ডাস্টবিন, কঠিন ও তরল বর্জ‍্য নিষ্কাষণ, সৌর বিদ‍্যুৎ চালিত আলো ও পাখার ব‍্যবস্থা, সোপ ব‍্যাঙ্ক, ওয়াটসন বক্স, স্বাস্থ‍্যবিধি অনুসরণ করে স্বাস্থ‍্যাভ‍্যাস গড়ে তোলার জন‍্য প্রার্থনার সময় নখ – চুল – দাঁত – পোষাক – জুতো পরীক্ষা, উচ্চতা ও ওজন নির্ণয়, রক্তের গ্রুপ ও টিকাকরণের রেজিস্টার, আয়রন ও কৃমির ঔষধের ব‍্যবস্থা সহ পড়ুয়াদের স্বাস্থ‍্য ও চক্ষু পরীক্ষা, কুপ্রথা – বাল‍্য বিবাহ – শিশু শ্রম – মাদক ও প্লাস্টিক বর্জনের জন‍্য প্রচারাভিযানে সামিল হচ্ছে পড়ুয়ারা। বছরে বেতন হিসাবে এক কে, জি, করে প্লাস্টিক দেয় পড়ুয়ারা। তা দিয়ে তৈরি হওয়া ইকো ব্রিক্স ব‍্যবহৃত হচ্ছে গাঁথনীতে। ইকো ব্রিক্স, বোতল বাগান ও বীজ কলম তৈরি করে পড়ুয়ারা প্লাস্টিক বর্জনে নতুন দিশা দেখাচ্ছে। বাতিল টায়ার ও সাইকেলের স্পোক দিয়ে উলম্ব বাগান তৈরি, কেঁচো ও জৈব সারের পট, ফ্লোরাইড ফ্রি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল‍্যান্টের মাধ‍্যমে পরিশ্রুত পানীয় জলের ব‍্যবস্থা সহ জল পানের সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে ওয়াটার বেল প্রজেক্ট, নান্দনিক পানীয় জলের বেসিন, জলের পুনর্ব‍্যবহারের জন‍্য জল ধরো – জল ভরো প্রকল্প, গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ সিস্টেম, রেন ওয়াটার হারভেস্ট, বাড়িতে বাড়িতে গাছ লাগানো উৎসাসিত করতে প্রতি বছর পড়ুয়াদের ফলের চারা বিতরণ ও শ্রেষ্ঠ বৃক্ষ পালকের পুরস্কার প্রদান ইত‍্যাদি কাজগুলিতে বিদ‍্যালয়ের ইকো ক্লাব ও বায়োডাইভারসিটি ক্লাব যোগ‍্যতর ভূমিকা পালন করছে।

মধ‍্যাহ্নকালীন আহারে
অর্ধাহারে থাকা আদিবাসী পড়ুয়াদের কাছে মিড – ডে – মিল যেন জীবন্ত আশীর্বাদ। এ কথা মাথায় রেখে আহার কর্মসূচিকে বৈচিত্র‍্যপূর্ণ করতে বিদ‍্যালয়ের সবজী বাগানে উৎপাদিত সবজীর ব‍্যবহার, মাশরুম, নানা রকম ফল, ইডলি, জিলাপী, মিস্টি, পোলাও সহ নানান স্বাদের পদ, পাখিখামারে উৎপাদিত মাংসের ব‍্যবহার পড়ুয়াদের রোজ স্কুলে আসতে বাধ‍্য করছে। ধৃমহীন চুল্লীতে রান্নার ব‍্যবস্থা থাকলেও ২০১৭ সাল থেকেই এল. পি. জি. – র ব‍্যবহার শুরু হয়েছে। স্বাস্থ‍্যবিধি মেনে পুষ্টিকর খাবার রান্নার জন‍্য স্বনির্ভর দলের মহিলাদের রান্নার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত ভাবে দু’জন ভোজন মাতা প্রতিদিন স্কুলে এসে খাদ‍্যের গুণমান পরীক্ষা করছেন। শিক্ষক – শিক্ষিকা ও বিশিষ্টজনেরাও এই প্রকল্পে নানান সময়ে অনুদান দিচ্ছেন। অভিনব হ‍্যান্ডওয়াশ স্টেশনে ছড়া বলতে বলতে পাঁচটি ধাপ মেনে হাত ধোয়া, ইনোভেটিভ প্লেট ওয়াশ স্টেশন, শস‍্য সংরক্ষণের জন‍্য ড্রামের ব‍্যবস্থা, সকলের জন‍্য থালা – বাটি – গ্লাস, মিক্সার গ্রাইন্ডার, ফ্রিজ সহ আধুনিক মানের রান্না ঘর, সুসজ্জিত ডাইনিং হল এই প্রকল্পের গুণগত মানকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে।

গ্রাম‍্য জীবনের রূপান্তরে
প্রাথমিকের পরের ধাপগুলি পড়াশুনা করার জন‍্য হাই স্কুল ও কলেজের পড়ুয়াদেরকেও আর্থিক সাহায‍্য সহ ছুটির দিনে ফ্রি কোচিং -এর ব‍্যবস্থা, গ্রামে রাস্তা, জল ও বিদ‍্যুতের ব‍্যবস্থা করতে গ্রামবাসীদের সহায়তা দান, রাস্তার পাশে ফলের বাগান তৈরি, জৈব চাষে উৎসাহিত করতে চাষীদের প্রশিক্ষণ সহ বছরে দু’বার স্কুলের নার্সারি থেকে সবজী চারা, বীজ ও জৈব সার প্রদান, কিশোরীদের বয়:সন্ধি কালের প্রশিক্ষণ সহ ন‍্যাপি ক্লাবের মাধ‍্যমে স্বল্প মূল‍্যে স‍্যানিটারী ন‍্যাপকিন সরবরাহ, বাল‍্য বিবাহ রোধে মেয়েদের জন‍্য খেলার পোষাক ও জুতো প্রদান, বিনামূল‍্যে শারীর শিক্ষার প্রশিক্ষণ, গ্রামের টিন এজারদের জন‍্য ফুটবল, ক্রিকেট সেট, ভলিবল প্রদান ধারাবাহিক ভাবে চলছে। এই কাজেও নানান মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বর্জ‍্য নিষ্কাষণের জন‍্য দু’টি করে গর্তে ময়লা সংগৃহীত হচ্ছে। স্বাস্থ‍্য ও চক্ষু পরীক্ষা শিবির, রক্তদান শিবির সংঘটিত করা সহ বিদ‍্যালয়ের অনুরূপ স্বাস্থ‍্যাভ‍্যাস গ্রামগুলির অভ‍্যন্তরেও গড়ে উঠেছে। সাথীর অনুদানে বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয়েছে ধূমহীন চুল্লি। দেওয়া হয়েছে গ‍্যাস ব‍্যবহারের নিরাপত্তা জনিত প্রশিক্ষণ।
স্কুলের কমিউনিটি লাইব্রেরি ও সংবাদপত্র সহ কমিউনিটি টয়লেট ব‍্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন গ্রামবাসীরা। স্বনির্ভর দলের মহিলাদের বিকল্প রোজগারের দিশা দেখাতে পাপোষ, ঝাঁটা, ঝুড়ি তৈরির প্রশিক্ষণ, মাশরুম উৎপাদন, বাবুই ঘাসের হস্ত শিল্প‍ের প্রশিক্ষণ, জাঙ্ক জুয়েলারী তৈরির প্রশিক্ষণ, পাট, কচুরিপানা ও বাঁশ দিয়ে সৌখিন দ্রব্য তৈরির প্রশিক্ষণ, পাঁচটি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে মহিলাদের বিনা ব্যয়ে সেলাই প্রশিক্ষণ, প্রায় ৪০০ জন মহিলাকে মাছ চাষের জন্য বিনা মূল্যে চারাপোনা ও সারা বছরের মাছের খাবার প্রদান, রঙিন মাছের চাষ করার জন্য ট্যাংক সরবরাহ, হাঁস ও মুরগী বাচ্চা বিলি ইত্যাদি করা হচ্ছে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটাতে না পারলে স্কুল ছুট বন্ধ করা যাবে না বলেই স্কুলের পক্ষ থেকে কমিউনিটি ডেভলপমেন্টের নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানান দপ্তর এই কাজগুলিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এলাকার মানোন্নয়নে
গোবিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা ছাড়াও আটটি ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে মহিলাদের আত্ম মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আমেরিকার মাউন্ট এরি ও পুরুলিয়া রোটারি ক্লাবের উদ্যোগে দু ‘ বছর ধরে ৫০ টি বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করে ৫৬৭ জন নিরক্ষরকে সাক্ষর করা হচ্ছে। বিভিন্ন মিশন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য লাগাতার কর্ম উদ্যোগ জারি আছে। প্রতি বছরেই পুজোর সময় প্রায় পাঁচ হাজার দরিদ্র মানুষকে জামা কাপড় ও শীতকালে প্রায় তিন হাজার মানুষকে কম্বল দিচ্ছেন শ্রীমদ রাজচন্দ্র মিশন। এলাকার বিদ্যালয়গুলির পড়ুয়াদের উৎসাহিত করতে খাতা, কলম ও চকলেট বিতরণ করা হচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের ছয় মাসের জন্য শিশু খাদ্য দিচ্ছেন অন্তর রাষ্ট্রীয় পুষ্টি মার্গীয় পরিষদ। যুব সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করতে ক্রীড়া সরঞ্জাম ও ফলের চারা বিতরণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে এই কাজগুলি দেখতে জাপান, আমেরিকা থেকে প্রতিনিধিরা বিদ্যালয়ে এসে উৎসাহিত করছেন।

অতিমারি প্রতিরোধে
বিদ‍্যালয়ের দান পাত্রে অনুদান সংগ্রহ করে মূখ‍্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সাহায‍্য পাঠানোর পর পড়ুয়াদের শিক্ষায় ঘাটতি পূরণের জন‍্য গ্রামের ক্লাব ঘরে সিনেমায় পাঠশালা, পাহাড় কোলে মুক্ত শিক্ষাদান কেন্দ্র চালু, সোসাল সাইটে গ্রুপ খুলে ভিডিও দেখিয়ে পাঠদান, নানৃতম – এর উদ‍্যোগে দু’টি সুসজ্জিত বই তৈরি করে পাঠদান ইত‍্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে সরকারী উদ‍্যোগে পাড়ায় পাঠশালাও বাস্তবায়িত হয়েছে। সম্প্রতি এই কাজ খতিয়ে দেখতে পদ্মভূষণে সম্মানিত অধ‍্যাপক কৌশিক বসু সুদূর আমেরিকা থেকে এই বিদ‍্যালয় পরিদর্শনে এসেছিলেন। দেশের নানান জায়গা থেকে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরাও এই কর্মসূচি পরিদর্শন করে গেছেন।

সমাজ সেবার অঙ্গনে
বিদ‍্যালয় সংলগ্ন গ্রামগুলি ছাড়াও অন‍্যান‍্য গ্রামগুলির বিশেষ করে শবর সম্প্রদায়ের শিশুদের শিক্ষার স্রোতাভিমূখী করতে শিক্ষাপোকরণ সহ শিশু খাদ‍্য পৌঁছে দেওয়া, ৫০৩ টি শবর পরিবারের সকলকে নতুন পোষাক ও খাদ‍্যসামগ্রী প্রদান, বৃদ্ধ – বিধবা ও অসহায় মানুষের জন‍্য প্রয়োজনীয় সাহায‍্য দান, অতিমারীর সময়ে ১৭৮ গ্রামের ১০,১৪৯ টি পরিবারকে খাদ‍্যদ্রব‍্য, আলু ও ভোজ‍্য তেল সরবরাহ, আটটি ব্লকের ৫৪৬ টি অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চাকে শিশু খাদ‍্য প্রদান, ৭২৩৮ জনকে মাস্ক, সাবান ও করোনা সচেতনতার লিফলেট বিলি, আর্সেনিকা এলবাম ঔষধ প্রদান, কনটেনমেন্ট জোনে থাকা গ্রামে খাবার ও ঔষধ সরবরাহ, বিদ‍্যালয় সহ মোট ১২ টি জায়গায় অক্সিজেন ক্লাব তৈরি, ৩৮৩৪ টি পরিবারকে কম্বল ও টুপি প্রদান, ১৯ টি গ্রামের বাচ্চাদের সোয়েটার, খেলনা সেট, ফুটবল ও ক্রিকেট সেট প্রদান, ১২ টি ক্লাবকে ফুটবল ও মাস্ক প্রদান, ২৬৫ জন চাষীকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে ঘঙ প্রদান, ২০০ জন চাষীকে চারা, বীজ ও জৈব সার প্রদান, উচ্চ বিদ‍্যালয়গুলিতে ন‍্যাপি ক্লাব তৈরি ইত‍্যাদি কাজগুলি নানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও শুভানুধ‍্যায়ীদের অনুদানে বিগত দু’ বছর ধরে অনলস ভাবে চলেছে।

পুরস্কারের অলিন্দে
মেধা অন্বেষণ পরীক্ষায় ও চতুর্থ শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় সাফল‍্য, রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ুয়া ভর্তি সহ ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও চিত্রাঙ্কনে ব‍্যক্তিগত ও দলগত বিভাগে বিভিন্ন স্তরের প্রতিযোগিতায় পড়ুয়ারা পুরস্কৃত হচ্ছে বারে বারে। জেলায় প্রথম স্থানাধিকার করে রাজ্য স্তরে খেলতে যাচ্ছে আদিবাসী গ্রামের লাজুক শিশুটি। উৎকর্ষতার নিরিখে ২০১২ সালে নির্মল বিদ‍্যালয়, ২০১৩ সালে শিশু মিত্র, ২০১৪ সালে জেলার সেরা বিদ‍্যালয়, ২০১৫ সালে রাজ‍্যে প্রথম স্থানাধিকার করে যামিণী রায় পুরস্কার, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ‍্য সেরা বিদ‍্যালয় পুরস্কার এবং ২০১৭ সালে জাতীয় স্তরের স্বচ্ছ বিদ‍্যালয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে এই বিদ‍্যালয়। ২০১৯ সালে স্বল্প ব‍্যয়ে শিক্ষাপোকরণ তৈরির জন‍্য জাতীয় স্তরের উদ্ভাবনী পুরস্কারও এসেছে বিদ‍্যালয়ে। ২০১৮ সালে বিরলতম ঘটনা হিসাবে প্রাথমিক ও মাধ‍্যমিক বিভাগের শিক্ষকদের মধ‍্যে পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ‘ জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার ‘ এবং একই সাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ শিক্ষারত্ন ‘ হিসাবে সম্মানিত হয়েছেন এই বিদ‍্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। জাতীয় স্তরে প্রধান শিক্ষকের ‘ মেন্টর ‘ হিসাবে নিযুক্তি, রোটারি ভোকেশনাল এওয়ার্ড, মানরত্ন সম্মান সহ ব্লক ও জেলা প্রশাসনের নানান সম্মানে বিদ্যালয়ের কর্ম পরিধি বারে বারে উৎসাহিত হচ্ছে।

শেষের কথা
কেবলমাত্র একটি বিদ‍্যালয়ের অগ্রগতি বৃহত্তর সমাজের কাছে মৃল‍্যহীন। আগামী দিনে এ রকম চিন্তা ধারায় অসংখ‍্য বিদ‍্যালয় গড়ে উঠলে সমাজ আক্ষরিক অর্থেই লাভবান হবে এবং শিক্ষা মানচিত্রে পুরুলিয়া জেলা সহ পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান আরো দৃঢ় হবে। সর্ব শিক্ষা মিশনের উদ্যোগে ১১৫৩ জন বিদ্যালয় প্রধান এই বিদ্যালয় পরিদর্শন করে গেছেন। এদের মাধ্যমে নিজেদের বিদ্যালয়ে কিছু কাজের প্রয়োগ ঘটলে সমাজ লাভবান হবে। এর জন‍্য আন্তরিক সদিচ্ছা গৃহীত হোক সর্বস্তরে।

( মতামত লেখকের নিজস্ব )

Post Comment