insta logo
Loading ...
×

স্বপ্নাদেশে জেগে ওঠা জগদ্ধাত্রী, কুমারীর ভোগে থাকে ক্যাডবেরি

স্বপ্নাদেশে জেগে ওঠা জগদ্ধাত্রী, কুমারীর ভোগে থাকে ক্যাডবেরি

সুইটি চন্দ্র, পুরুলিয়া

স্বয়ং দেবী দিয়েছিলেন স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নাদেশ থেকেই শুরু এক অনন্য আধ্যাত্মিক উপাখ্যান। পুরুলিয়া শহরের দুই প্রান্তে — নন্দী পরিবারের ও সরকারপাড়ার — দুই জগদ্ধাত্রী পুজো আজ ঐতিহ্যে মিশে গেছে পুরুলিয়ার ধর্মচেতনায়।

শহরের নন্দী পরিবারের জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। পরিবার সূত্রে জানা যায়, মা সারদার মন্ত্রশিষ্য স্বামী কৃষ্ণানন্দজি মহারাজের দীক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন বৃন্দাবন নন্দী, গোলক নন্দীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। সেই কৃষ্ণানন্দজির অপর শিষ্য স্বত্মানন্দ মহারাজ এক রাতে স্বপ্নে দেখেন, বৃন্দাবন নন্দীর বাড়ির পুকুর থেকে এক দেবী রমণী উঠে এসে পাড়ে বসেছেন। পরদিন তিনি সেই স্বপ্নের কথা বৃন্দাবন নন্দীকে জানান। দুই গুরুভ্রাতার আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়, ওই বাড়িতেই দেবীর পুজো শুরু হবে — কারণ তখন কালীপুজো পার হয়ে গেছে। সেইভাবেই স্বপ্নাদেশ থেকেই সূচনা হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর।

প্রথম তিন বছর ছোট প্রতিমা গড়ে পুজো হয়েছিল। চতুর্থ বছর থেকে শুরু হয় বড় আকারের পূজা — তৈরি হয় নতুন বেদী, আর পুরুলিয়ার স্বনামধন্য শিল্পী ধ্রুব দাসের হাতে গড়ে ওঠে দেবীমূর্তি। সেই সময় বিখ্যাত ফটোগ্রাফার সুবোধ মুখোপাধ্যায় পুজোর ছবি তোলেন। এবারের মহানবমীতে প্রকাশ পেয়েছে পুরুলিয়ার নন্দী পরিবারের জগদ্ধাত্রী পুজো নামের একটি পুস্তক, যাতে পরিবারের ৬২ জন সদস্যের অনুভূতি, গান, কবিতা ও ছবি স্থান পেয়েছে। সম্পাদনা করেছেন পরিবারের জামাতা তথা জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ফটোগ্রাফার স্বরূপ দত্ত।

নন্দী পরিবারের সদস্য প্রদীপ কুমার নন্দী বলেন, “আজও বাঁকুড়া থেকে ঢাক আসে, যেমনটা তখন আসত। নবমীর দিন একসঙ্গে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পুজো হয়। কুমারী পুজো, যজ্ঞ ও বলিদান—সবই হয় নিখুঁত নিয়মে। কুমারী পুজোয় এক ব্রাহ্মণকন্যাকে দেবী রূপে সাজিয়ে বসানো হয়, তাকে নিবেদন করা হয় পাঁচরকম ফল, মণ্ডা, লাড্ডু, শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ প্রভৃতি।”

অন্য দিকে, প্রায় ১২ বছর আগে সরকারপাড়ায় শুরু হয় আর এক জগদ্ধাত্রী আরাধনা — রাজরাজেশ্বরী রূপে। এখানেও সূত্রপাত স্বপ্নাদেশ থেকেই। পুজোর মূল উদ্যোক্তা গৌতম রায় স্বপ্নে দেখেন, সরকারপাড়ার দুর্গামন্দিরে দেবী নিজেই পূজিতা হচ্ছেন। পরদিনই সিদ্ধান্ত হয় দেবীর আরাধনা করার। কালীপুজোর পরের দিনই শুরু হয় মূর্তি নির্মাণ।

প্রথমে মূর্তি গড়তে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হলেও পরে ঝাড়খণ্ডের বোকারোর শিল্পীর হাতেই তৈরি হয় রাজরাজেশ্বরীর প্রতিমা। সেই থেকে আজও সিংহবাহিনী দেবী সোনার অলঙ্কারে সজ্জিতা অবস্থায় পূজিতা হন। মাথায় সোনার মুকুট, গলায় সীতাহার, নানা সোনার গয়না — মহারানির সাজে দেবী বিরাজ করেন। কুমারী পুজো এখানেও অন্যতম আকর্ষণ। কুমারীকে নিবেদন করা হয় নানা ভোগের সঙ্গে ক্যাডবেরি চকোলেটও আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের অনন্য মেলবন্ধন।

এ বছর ২৮ তারিখে উদ্বোধন হয় এই পুজোর। উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ।

পূজার মূল উদ্যোক্তা গৌতম রায়, বলেন, “এই পূজার বিশেষত্ব হলো অষ্টমী, নবমী ও দশমী তিন ধাপের পূজা একই দিনে সম্পন্ন হয়। সপ্তমীতে মাকে নিবেদন করা হয়েছিল প্রায় ৭০ রকমের মিষ্টান্ন ও নানা ফল নৈবেদ্য। অষ্টমীতে মাকে দেওয়া হয় ঘিয়েভাজা ১০৮টি লুচি, বোঁদে ও ফল-মিষ্টি। নবমীতে দেবীকে অন্নপ্রসাদ দেওয়া হবে — যার মধ্যে থাকবে নবরত্ন সবজি, পায়েস, অন্ন ও বিভিন্ন ভাজা। সন্ধ্যেবেলায় অস্ত্র আরতির পর দেবীকে নিবেদন করা হবে প্রায় দেড় কুইন্টাল চালের পোলাও — যা মায়ের “বাদশা ভোগ” হিসেবে পরিচিত। পরে এই প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে।”

পুরুলিয়ার দুই প্রান্তে — নন্দী পরিবার ও সরকারপাড়ায় — দুই স্বপ্নাদেশেই শুরু হয়েছিল দেবীর পূজা। এক পুকুরপাড়ে দেবীর আবির্ভাব, অন্যদিকে স্বপ্নে দেখা রাজরাজেশ্বরী। দুই পুজোর ক্ষেত্রেই লোকবিশ্বাস এক — মা নিজেই পথ দেখিয়েছিলেন, আর সেই থেকেই গড়ে উঠেছে এক অনন্য আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য। আলোকসজ্জা, ঢাকের বাজনা, কুমারী পুজো, আর দেবীমূর্তির মুখে আভা—পুরুলিয়ার এই দুই জগদ্ধাত্রী পুজো আজ শুধুই আচার নয়, আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারও বটে।

Post Comment