insta logo
Loading ...
×

ইতিহাস রক্ষায় আড়াই কোটি

ইতিহাস রক্ষায় আড়াই কোটি

সুজয় দত্ত, দেউলঘাটা(আড়শা):

বরাদ্দ হয়েছে অর্থ। আড়াই কোটি টাকায় রক্ষা করা হবে ইতিহাসকে। সেই ইতিহাস দু হাজার বছরের প্রাচীন।

পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের এক অনন্য রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে দেউলঘাটা। কংসাবতী নদীর তীরে এক মনোরম পরিবেশে এই পুরাতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের অবস্থান। নদী এখানে উত্তরবাহিনী। ভারতে এক বিরল দৃশ্য। কথিত উত্তর বাহিনী নদীস্থল ঈশ্বর সাধনার উপযুক্ত স্থান। ফলে সেই প্রাচীন কাল থেকে বেড়েছে দেউলঘাটার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব। পুরুলিয়া জেলার বুকে প্রাচীন সংস্কৃতির চিহ্ন নিয়ে ঐতিহ্য মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিদ্ধ স্থান দেউলঘাটা। পুরুলিয়া জেলার আড়শা থানার কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত দেব দেউলে ভরা দেউলঘাটা। কিছু দূরেই কংসাবতী ও গোরা নদীর সঙ্গমস্থল। প্রাচীন সুউচ্চ দেউল নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে দেউলঘাটা।

বিশেষজ্ঞদের মতে অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে লম্বা লম্বা মাটির ইটে নির্মীত মন্দিরগুলোর বাইরে ছিল পোড়ামাটির অপূর্ব সব কারুকাজ । হাজার বছর আগেকার পাথরের দুর্গা মূর্তির পূজা হয় এখানে। অষ্টসিদ্ধি প্রদায়িনী সিদ্ধেশ্বরী চণ্ডীর সিংহবাহিনীর মহিষমর্দিনী মূর্তি এখানে অষ্টমাতৃকার রূপে বিরাজমানা। গঠনশৈলী এই মূর্তিকে বর্তমানে প্রচলিত দেবীর মূর্তি একটু আলাদা করেছে। পুরোহিত দর্পণ শাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রের সঙ্গে এই মূর্তিটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। আত্ম নিবেদনের পরিপূর্ণতায় শিল্পীর প্রাণস্পর্শে বিগ্রহ যেন জাগ্রত জীবন্ত প্রাণবন্ত। পুরোহিত দর্পণে দেবী দুর্গার ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী দেবীর বাঁ পা মহিষের ওপর থাকার কথা। কিন্তু দেউলঘাটার দেবী মূর্তির ডান পা মহিষের উপর বিরাজমান । অনেকেই আবার এই মূর্তিকে পাল যুগের বলে অনুমান করেম। আবার মূর্তির মাথার ওপরে অষ্টদল পদ্ম থাকায় মনে করা হয় বৌদ্ধ প্রভাব পড়েছে এর ওপর। কলকাতা জাদুঘরে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া অন্য একটি কালো পাথরের দুর্গা মূর্তি রক্ষিত। দেউলঘার সরকারি ভাবে কোনও ইতিহাস এখন পযন্ত পাওয়া যায়নি। মহালয়ার দিন চণ্ডীপাঠ দিয়ে শুরু হয় পুজার সূচনা। এখানে পূজার চারদিন মহাধুমধামে শাস্ত্রমতে পালিত হয়। এখানে বলি প্রথা আছে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে এবং বছরের প্রতিটা দিন রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সাথে ভিন রাজ্যের বহু পর্যটক আসেন। তবু সরকারি উদাসীনতা এই প্রত্নক্ষেত্রের উন্নয়নে কাজে আসেনি।

এবার ঘুচতে চলেছে বঞ্চনা।পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের অন্তর্গত রাজ্য পুরাতত্ত্ব অধিকারের তত্ত্বাবধানে ২ কোটি ৪৯ লক্ষ ৩৬ হাজার ৩১৮ টাকা বরাদ্দে পুরুলিয়া জেলার প্রাচীনতম তীর্থস্থান দেউলঘাটা মন্দিরের সংরক্ষণ ও মেরামতের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। ৭৩০ দিনের এই কাজ। এ কাজের দেখভাল করবেন পি ডব্লিউ ডি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, জেলাশাসকের তত্ত্বাবধান জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক এবং বিডিও। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ কমিশন দেউলঘাটাকে রাজ্য সংরক্ষিত সৌধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

গবেষক তথা পুরুলিয়া বিশেষজ্ঞ দিলীপ কুমার গোস্বামী বলেন, “পূর্ব ভারতের মধ্যে এমন ইটের তৈরি মন্দির বিরল। শুনেছি সাতটি দেউল ছিলো এখানে। আমরা তিনটি মন্দির দেখেছি। ইটের গায়ে ছিলো অপূর্ব সব পৌরাণিক চিত্র। এর আগেও মন্দিরের সংরক্ষণের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। কাজ শুরু হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এমন সব কর্মীরা কাজ করলেন, ইটের মন্দির সংরক্ষণের কাজে যাঁদের কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। ফলে ২০০২ সালে একটি মন্দির ধ্বসে যায়। আমার অনুরোধ এমন কর্মীরা এই মন্দির রক্ষণের কাজ করুন, যাঁদের এ কাজে অভিজ্ঞতা আছে।”

গবেষক তথা প্রাবন্ধিক সুভাষ রায় বলেন, ” এর আগেও তো দেউলঘাটার দেউলগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু এমন ভাবে সেই কাজ হল যে, একটা মন্দিরই ধসে পড়ল। বর্ষাকালে কাজ শুরু হয়। প্রাচীন এবং সবচেয়ে বড়ো দেউলটির চারপাশে গর্ত খোঁড়া হয়েছিল৷ জল জমে পুরনো ইট গেল গলে৷ এবার যেন পুরাতাত্ত্বিক নিয়ম মেনে কাজ হয়। নইলে ভবিষ্যতের জন্য কোন ঐতিহ্য রেখে যাব আমরা?”

জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধীনস্থ রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের তত্ত্বাবধানে পুরুলিয়ার আড়শা ব্লকের সুপ্রাচীন দেউলঘাটা অঞ্চলের ৩ টি মন্দির এর পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। পুরাতাত্ত্বিক, ঐতিহ্যবাহী, ঐতিহাসিক এই স্থানে পশ্চিমবঙ্গতো বটেই, দেশ বিদেশের বহু পর্যটক আসেন। পুরানো কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে যাতে আরো বহুকাল এই প্রাচীন পুরাকীর্তিকে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা যায় তার জন্য সচেষ্ট বর্তমান সরকার।”

Post Comment