সুজয় দত্ত ও বিশ্বজিৎ সিং সর্দার :
শুক্রবার। সন্ধ্যা সাতটা বেজে পার হয়েছে কিছুক্ষণ। তালপাত থেকে জানিঝোড় যাচ্ছিলেন এক মোটরবাইক আরোহী। হঠাৎ কুইলাপাল-বান্দোয়ান রাস্তায়
নেকড়া গ্রামের কাছে বাইকের হেডলাইট যার ওপর পড়ল তাতে আতঙ্কে বাইক থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন তিনি। কোনমতে সামলালেন নিজের নার্ভ। বড়জোর কয়েক সেকেন্ড। তার মোটরবাইকের ৫-৬ হাত দূরে রাস্তা পারাপার করল জিনাতের আশিক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।

গাড়ির হেডলাইটের সামনে হলুদ কালো ডোরাকাটা সাক্ষাৎ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন বান্দোয়ানের জানিঝোড় গ্রামের বাসিন্দা যুধিষ্ঠির মাহাতো। কী করবেন আর কী করবেন না, তৎক্ষনাৎ বুঝে উঠতে পারেননি চাষাবাদের কাজ করা ওই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, “আমি তালপাত থেকে নিজের বাড়ি জানিঝোড় যাচ্ছিলাম । সেই সময় কুইলাপাল-বান্দোয়ান রাস্তায় আমার মোটর বাইকের সামনে ৫-৬ হাত দূরে বাঘ চলে আসে। একেবারে হলুদ ডোরাকাটা। খুবই ভয় লাগছে। পাশে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে থাকা মানুষজনকে বললাম। তারাই বনদফতরে খবর দেয়। এরপর ওরা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।”
জিজ্ঞাসাবাদে থেমে থাকেনি বন দফতর। খোঁজ চালিয়েছে ওই এলাকায়৷ হ্যাঁ, মিথ্যে বলেননি যুধিষ্ঠির। সেখানে মিলেছে বাঘের পায়ের ছাপ। কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগের অনুমান, রাইকা পাহাড়ের জঙ্গলে জিনাতের অস্থায়ী ডেরাতেই আস্তানা গেড়েছে জিনাতের আশিক। এখানেই জিনাত পাঁচ দিন কাটিয়েছিলো। জিনাতের খোঁজে আসা তার প্রেমিক পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম বনাঞ্চল সহ এই পাহাড়ে ৬ দিন পার করে দিল। না গিলেছে টোপ। না ধরা দিয়েছে ট্র্যাপ ক্যামেরায়। না খেয়েছে জ্যান্ত ছাগল, না খেয়েছে শুয়োর মাংস। তিন নম্বর দিনে ছাগলের মাংস নুন দিয়ে মাখিয়ে দীর্ঘক্ষণ রোদে পঁচিয়ে টোপ দেওয়া হয়েছিল। সে টোপও খায়নি প্রেমিকপ্রবর। ফলে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিকল্পনা। কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে বাঘিনীর মূত্র নিয়ে এসে এদিন সবুজ খাঁচার টোপের চারেপাশে তা স্প্রে করা হয়। জিনাতের আশিককে আকৃষ্ট করতে বাঘবন্দি অভিযানে এমন অভিনব কৌশল রাজ্যের বন বিভাগের। পৃথক পৃথক এলাকায় তিনটি সবুজ খাঁচা পাতা হয়। এবার আশিকের প্রেমের টানকে কাজে লাগাতে চাইছে বন দফতর।

রাজ্যের মুখ্য বনপাল (পশ্চিম চক্র) সিঙ্গরম কুণালডাইভেল বলেন, ” আমরা আজ সকালের দিকে যমুনাগোড়া এলাকায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখি। সেখানকার মানুষজনদের সঙ্গে কথা বলি। তারপর নতুন পৃথক তিনটি এলাকায় টোপ দিয়ে খাঁচা পাতা হয়েছে।”
গত বছরের ২২ ডিসেম্বর পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়ের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে রয়্যাল বেঙ্গল বাঘিনী জিনাত। ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে ঝাড়খণ্ড, ঝাড়গ্রাম হয়ে পুরুলিয়া আসে সে। ২৯ তারিখ তাকে বাঁকুড়ার রানিবাঁধের গোঁসাইডি এলাকায় ঘুমপাড়ানি গুলি ছুঁড়ে কাবু করা হয়। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে ১ জানুয়ারি ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে নিজের বাড়িতে ফিরে যায় জিনাত। আর সেদিনই পুরুলিয়া সীমান্তে ঝাড়খণ্ডের সরাইখেলা-খরসোঁওয়া জেলার চাণ্ডিল শহর সংলগ্ন চৌকা থানার তুল গ্রামের বালিডি জঙ্গলে দেখা মেলে এই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটির। ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ওড়িশা থেকে পুরুলিয়া আসার দীর্ঘ পথে কোথাও এই বাঘটির সঙ্গে দেখা হয়ে থাকতে পারে জিনাতের। আর তার টানেই ঠিক জিনাতের ফেলে আসা পথে চরকিপাক খাচ্ছে তার আশিক।

শেষ পাওয়া খবরে শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার রাইকা পাহাড় থেকে নেমে এসে নেকড়া হয়ে বান্দোয়ান-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়ক পার করে একটি পুকুর সাঁতরে হাতিরামগোড়া হয়ে বোরোর দিকে চলে যায়। ঠিক যে পথে গিয়েছিল জিনাত, সেই পথেই যাচ্ছে তার আশিক৷ এখন মাইকিং চলছে মানবাজার ২ নং রেঞ্জে। সতর্ক করা হচ্ছে বন দফতরকে।










Post Comment