সুজয় দত্ত, বিশ্বজিৎ সিং সর্দার :
ভয় নেই। ভয় আছে। পুরুষেরা বাঘবন্দি পরব দেখতে এগিয়ে যাচ্ছেন জঙ্গলের দিকে। তাদের সামলাতে কার্যত হিমসিম খাচ্ছে প্রশাসন। অথচ তারাই বাঘিনীর ভয়ে গবাদিপশুদের গৃহবন্দি করে রেখেছেন। আবার বাঘিনী জিনাতের ভয়ে কচিকাঁচাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না তারা। গ্রামের গাছতলায়, ঘরে রেখে গবাদি পশুদের পরিচর্যা চলছে। রাইকা পাহাড়ের পাদদেশের গ্রাম রাহামদা, কেশরা, উদলবনি, লেদাশোল, বারুডি, কেন্দডি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল সেই দৃশ্য।
রাহমদা গ্রামের বাসিন্দা বাসন্তী টুডু, বেনুবালা মুর্মুরা বলছেন ” রবিবার মাইকিং করে জানানো হয়েছিল জঙ্গলে বাঘ এসেছে। সতর্কভাবে চলাফেরা করতে বলেছে। তাই আমরা আর কোন গবাদি পশুকে জঙ্গলে পাঠাইনি।” উদলবনি গ্রামের বাসিন্দা বাসুদেব মান্ডি বলেন, ” অবলা জীবের কাঁচা জীবন! জেনে শুনে তো আর বাঘের হাতে তুলে দিতে পারি না।”
অন্যদিকে বাঘের ভয়ে কচিকাঁচাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না গ্রামবাসীরা। উদলবনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝাঁপ বন্ধ। উপস্থিত পড়ুয়ার সংখ্যা ৩। তাই এক ঘন্টা হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যালয়। দরজা খোলেনি উদলবনি জুনিয়ার হাই স্কুলের। বলছেন উদলবনির বাসিন্দা শ্রীনাথ মান্ডি।
যে ছাগলের মাংস খেতে মানুষের জিভে জল ঝরে সেই বাংলার কালো ছাগলের টোপ দিয়েও বাঘবন্দি হল না। রাইকা পাহাড়ের জঙ্গলে কার্যত ‘লুকলুকানি’ ( লুকোচুরি) খেলছে সে।ফলে মহিষ, শূকর ও ছাগল পরপর টোপ দিয়েও এখনও অধরা জিনাত। দেড়মাস আগে ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে নিজের আস্তানা ছেড়েছিল এই বাঘিনী। তারপর ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি, ঝাড়খণ্ড হয়ে রবিবার থেকে ডেরা গেড়েছে পুরুলিয়ার কংসাবতী দক্ষিণ বন বিভাগের বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়ের জঙ্গলে। তাকে নিরাপদে নিজের বাড়িতে ফেরাতে চেষ্টার কসুর করছে না বনদপ্তর। রাতে তিন জায়গায় বসানো হয়েছিল খাঁচা। তিন জায়গাতে দেওয়া হয়েছিল টোপ। মহিষ, শূকর এবং ছাগল। মহিষ ও শূকরের টোপের আশেপাশে না গেলেও ছাগলের টোপটির পাশে গিয়েছিল জিনাত। অন্তত ট্র্যাকিং ডিভাইস তেমনি বলছে। জানালেন দক্ষিণ-পশ্চিম চক্রর মুখ্য বনপাল বিদ্যুৎ সরকার। তিনি বলেন, যেখানে ছাগলের টোপ দেওয়া হয়েছিল তার পাশ দিয়ে চলে যায় জিনাত। কিন্তু টোপের দিকে নজর দিয়েছিল কিনা তা বলা যাচ্ছে না। বন দপ্তরের প্রধান লক্ষ্য যে বাঘিনীকে তার আস্তানায় নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া সেকথাই জানালেন মুখ্য বনপাল। তিনি আরও জানান যে এই এলাকাতেই রয়েছে বাঘিনী।
পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া গেছে। মিলেছে বাঘিনীর বিষ্ঠা। রেচনাঙ্গের লোমও হদিশ পেয়েছেন বন দপ্তর এবং ব্যাঘ্র প্রকল্পের কর্মীরা। শুধু হদিশ নেই জিনাতের। তবে ব্যাঘ্র প্রকল্পের পক্ষে বাঘিনীকে জিনাত বলে চিহ্নিত করা হলেও বন দপ্তর তাকে শুধুই রয়্যাল বেঙ্গল বাঘিনী বলছে। সোমবার ভোর পাঁচটার পর আর ট্র্যাক করা যাচ্ছে না জিনাতকে। শ্যাডো জোন হওয়াতেই বারংবার টাওয়ার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে । দেখা দিচ্ছে রেডিও সিগনালে সমস্যা। তবে হাল ছাড়ছেন না সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের আধিকারিকরা। তাঁদের র্যাপিড রেসপন্স টিমের দুটি গাড়ি রীতিমতো চষে বেড়াচ্ছে রাইকার পাহাড়ের জঙ্গল। ক্যামোফ্লাজ পোষাক পরে নজরদারি চালাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের তত্ত্বাবধানে কংসাবতী দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মীদের টহলও চলছে।
এলাকার মানুষকে আতঙ্কিত হতে নিষেধ করছেন পুরুলিয়া
বনবিভাগেত ডিএফও অঞ্জন গুহ। তিনি বলেন, বন দপ্তর, প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। স্ট্র্যাটেজিগত ভাবে সমস্ত পদক্ষেপের বিশদ জানানো যাচ্ছে না, বললেন তিনি।
অন্যদিকে এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে প্রচুর পুলিশ। গ্রাউন্ড জিরো পরিদর্শন করে গেলেন পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, বন দপ্তর যেমন চাইছে, পুলিশ সেভাবেই সাহায্য করছে।
লুকোচুরি খেলছে জিনাত। লোভনীয় টোপেও টাল খায়নি সে। সে কি গর্ভবতী? তাই কি একাকীত্ব খুঁজছে? জানে না বন দপ্তর। আপাতত অপেক্ষা করছে তারা৷ কখন ফাঁদে পা দিয়ে বন্দি হবে বাঘিনী। তবেই তাকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া যাবে নিজের ঘরে।
Post Comment