দেবীলাল মাহাত,আড়শা:
গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ‘বিয়ের গীত’। লোকসঙ্গীতের ধারায় বিয়ের গীতের অবদান অপরিসীম। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক রীতি অনুযায়ী বিয়ের গীত অতীতে পরিবেশিত হতো। পুরো মাস জুড়ে দল বেঁধে বাড়িতে বসে মহিলারা ওই গান গাইতেন। আসর বসতো উঠোনে। শুধু মাত্র চিত্ত বিনোদন নয়। মহিলাদের সুখ, দুঃখের কথা ফুটে উঠতো ওই বিয়ের গীতে। স্যোশাল সাইটের যুগে সময়ের সাথে সাথে বিয়ের গীত আজ অতীত। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত ভাবে গীত গাওয়া হলেও , আধুনিকতার যুগে ক্রমশ সুর হারাচ্ছে লোকসংস্কৃতির ধারক,বাহক বিয়ের গীত বা বিহার গীত।
ষোড়শ সংস্কারের মধ্যে অন্যতম হলো বিবাহ। বিবাহ নামক সামাজিক রীতির অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত বিয়ের গীত (গান)। প্রচলিত ও তাৎক্ষণিক ভাবে রচিত এই গানগুলি লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। গীতগুলো আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং প্রজন্ম পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচারিত । গীতে শুধু চিত্ত বিনোদনই থাকে না। নারী মনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, আবেগ , উৎকণ্ঠা প্রকাশ ঘটে বিয়ের গীতে। ছোট ছোট মেয়েদের সামনে তার মা, দিদি, কাকিমা, মাসিমা বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত করে থাকেন। শিশুরা এই সব গীত শোনার সাথে সাথে তাদেরও মনে গেঁথে যায় গীত গুলো। পরবর্তী সময়ে তারা সেই গীত গুলো গাইতে থাকেন। এই ভাবে গীত গুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে যায়। যেহেতু গীত গুলো মুখে মুখে থেকে যায়,তাই গীত গুলোর কোনো লিখিত রূপ পাওয়া যায় না। যা লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্য । কুড়মি সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নানা পর্যায়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের গীত রয়েছে। এই গীত গুলো কুড়মি সম্প্রদায় মানুষজনের নিজস্ব সম্পদ। বিয়ের নানা আচার, অনুষ্ঠানে মহিলারা গীত গেয়ে থাকতো । তাদের নিজেদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। কুড়মি সমাজের লোকাচার গুলি হল সার উয়া মুড়ি, আমবিহা, ননদ ঝুঁটি, ঘটি লুকানো প্রভৃতি। গান গুলো নিম্নরূপ। যেমন – “মাথায় সিঁদূর পায়ে আলতা,
দুই হাতে দুই শাঁখা গো।
লাল শাড়ি পইরহে কোথায় যায়।
মাঅ কাঁদে বাবা কাঁদে,
কাঁদে সাধের ভাই গো।
(আজ) সাধের মুনুর দিছি গো বিদায়।।
বাবা মায়ের আদর যতন,
দাদার ভালবাসা গো।
জনম ভিটা, সঙি ছাড়্যে যায় ।।
বিটিছেল্যার কঠিন জনম,
এই জগৎ সংসারে গো।
বিদায় দিতে বুক ফাট্যে যায়।।
পরের ঘরে চল্যে যাবি, পরের মা কে মা বলবি।
বিধির বিধান নাই কন উপায়।।
সুখে থাকিস, ভাল থাকিস,
নিজের সংসারে গো।
হাঁসিমুখে দিলি গো বিদায়।।”
“এতদিন যে রাখলি মা গো,
ও গো ও মা ঘিয়ে দুধে ভাতে।
আজ কেনে বিকে দিলি,
ওগো ওমা পরের বেটার হাতে।।
ছুটু থেক্যে করলি ডাগর,
ও গো বাবা কোলে পিঠে কইরে।
আজ কেনে পাঠাঁই দিছিস,
ও গো বাবা পরের বেটার ঘরে।।
একই সঙে খেলাধূলা,
ও রে দাদা, সঙেই কাঁদা হাঁসা।
আজ রে দাদা ভুল্যে গেলিস,
ও রে দাদা বইনের ভালবাসা।।”
সীতারাম মাহাত মেমোরিয়াল কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুশান্তকুমার মাহাতো বলেন, ” কুড়মিদের নিজস্ব সম্পদ এই বিহার গীত। জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া- পাওয়ার কথা সাবলীল ভাবে ফুটে ওঠে এই বিহার গীতে। তার সঙ্গে সঙ্গে নববধূ শ্বশুরবাড়িতে কেমনভাবে থাকবে, তার আচার আচরণ কেমন হবে সেই সদুপদেশও দেওয়া হয় গীতে গীতে।
সময়ের সাথে সাথে গ্রামবাংলার বিয়ের এই গীত আজ অতীত। আধুনিকতার করাল গ্রাসে গান গুলি প্রায় বিলুপ্তের পথে । তবে লোকজ মননে তার রেশ এখনও বর্তমান। স্যোশাল সাইটের যুগে বর্তমান প্রজন্ম গীতে খুব একটা আগ্রহী নয়। তারা সিনেমার আইটেম গান শুনতে অভ্যস্ত। ফলে গ্রামগঞ্জে গীতের জায়গায় দখল নিয়েছে বড় বড় ডিজে,শব্দ দানব। শব্দ তান্ডব না থাকলে বিয়ের কথা ভাবতেই পারছে না নবীন প্রজন্ম। ভুলে যাচ্ছে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভুলে যাচ্ছে তাদের গ্রামীণ শেকড়। এতেই সিন্দুরে মেঘ দেখছেন গ্রামের প্রবীণ মানুষেরা। ইতিহাসের পাতায় স্থান নিবে নাতো বিয়ের গীত। একেবারে হারিয়ে যাবে নাতো লোকসংস্কৃতির ধারক ও বাহক বিয়ের গীত ।
Post Comment