বিশ্বজিৎ সিং সর্দার , বড়গোড়া :
রাস্তায় খুঁজলে কি এখনও মিলবে লাল রক্তের শুকিয়ে যাওয়া খয়েরি দাগ? জোর শ্বাস টানলে কি এখনও মিলবে বারুদের গন্ধ? উত্তর যদি না হয়, তবু একটা বিষয় সেই একই। গা ছমছমে পরিবেশ। ঘাটবেড়া থেকে খুনটাঁড় যেতেই বুকের স্পন্দন আরও বেড়ে যেতে বাধ্য। সারি সারি দাঁড়িয়ে বাইক। তাতে ক্যামোফ্লাজ পোশাকে পুলিশ। কারও হাতে একে ফর্টি সেভেন। আবার কারও হাতে এসএলআর।
বাইক বাহিনীর নেতৃত্বে স্বয়ং পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরও হাতে কালান্তক কালাশনিকভ। তাঁর সারথি ডিএসপি। তাহলে কি আবার মাও উপদ্রুত এলাকায় নতুন করে জ্বলল আগুন? আর নতুন কোন অপারেশনে এই বিশাল বাহিনী?
বাহিনীর পিছু পিছু অযোধ্যা পাহাড়ের বিচ্ছিন্ন গ্রাম বড়গোড়ায়। প্রায় ২ হাজার ফুট উঁচু বড়গোড়ায় ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে আসে ১৪ বছর আগের ঘটনা। ২০১০ সালের অক্টোবর মাস। কোজাগরীর পূর্ণচন্দ্র তখন অযোধ্যার আকাশে। মাও দমনে রাজ্য পুলিশের কাছ থেকে স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আসা আই বি ইন্সপেক্টর পার্থ বিশ্বাস ও তাঁর সঙ্গী শিক্ষক সৌমজিৎ বসুকে এই বড়গোড়া-আমকোচা থেকেই অপহরণ করে মাওবাদীরা। আর ফিরে আসেননি তাঁরা। বড়গোড়া থেকে কিছুটা দূরে বাঘমুন্ডির ছাতরাজেরা গ্রামের পড়াশিবন জঙ্গল থেকে তাঁদের পচাগলা দেহ উদ্ধার হয়।
তাহলে কি আবার সেই মাও আতঙ্কের ছায়া? ‘না, পাহাড় চূড়ার গ্রামে বাহিনী সহ পুলিশ সুপার এসেছেন গ্রামবাসীদের অভাব- অভিযোগ শুনতে। যে অনুন্নয়নের ছায়ায় আশ্রয় নিত মাওবাদীরা। সেই ছায়া যে আজও খানিকটা রয়ে গিয়েছে। নেই রাস্তা। পাহাড় চূড়ার গ্রাম আজও বিচ্ছিন্ন। নেই পানীয় জল। গ্রাম থেকে প্রায় ১ কিমি দূরে শুকিয়ে যাওয়া জোড়ের পাশে ‘দাঁড়ি’ খুঁড়ে কিংবা কুমারী নদীর জল-ই ভরসা। রাজের মেগা প্রকল্প লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আওতায় এখনও আসেননি ওই গাঁয়ের সকল মহিলা।
চারিদিকে সবুজ ঘেরা বড়গোড়ায় বাস করেন পাহাড়িয়া জনজাতির ১৯টি পরিবার। জঙ্গলের বনজ সম্পদ বিক্রি করেই দিন যায়। রেশনের চালটুকুতে পেট ভর্তি খাবার হয়তো মেলে। কিন্তু সব সুবিধা যে মেলে না। এবার সেই গাঁয়ে দুয়ারে সরকারের মত-ই দুয়ারে এসপি। সঙ্গে তাঁর ‘আস্থা’ প্রকল্প। বুধবার পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় শোনেন ওই জনজাতির মানুষজনের অভাব-অভিযোগ। রাস্তা নেই। বর্ষায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বড়গোড়া। ঢোকে না চার চাকার গাড়ি। পুলিশ সুপারকে বুধবার নিজেদের মাঝে পেয়ে গ্রামের মানুষজন মোট চারটি রাস্তার প্রস্তাব রাখেন। বড়গোড়া থেকে আমকোচা। আমকোচা থেকে ছাতরাজেরা। আমকোচা থেকে তিলাগোড়া। তিলাগোড়া থেকে খুনটাঁড়।
পুলিশ সুপার জানান, এই চারটি রাস্তার জন্য ওই এলাকার মানুষজনের গণস্বাক্ষর সম্বলিত আবেদন পত্র বাঘমুন্ডি ও বলরামপুর ব্লক প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, গ্রামের যে সকল মহিলারা লক্ষ্মীর ভান্ডার পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে যাতে ওই প্রকল্পের আওতায় আনা যায় সেই লক্ষ্যে শিবির গড়ে ফর্ম বিলোবে পুলিশ। প্রয়োজনে ফিল আপও করে দেবে। যথাস্থানে করবে জমা।
এলাকার মানুষজন বলরামপুরের খুনটাড় থেকে হেদেলবেড়ার বেহাল রাস্তার সংস্কারের দাবি করেছিলেন। সেই দাবি পথ নিরাপত্তা কমিটির কাছে তুলে ধরেন পুলিশ সুপার। তারপরেই অর্থ বরাদ্দ করে রাস্তার সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে পুরুলিয়া জেলা পরিষদ। বুধবার সেই রাস্তাও পরিদর্শন করেন এসপি।
পঞ্চায়েত ভোটে এই গ্রাম থেকে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী হয়েছিলেন সুমিত্রা পাহাড়িয়া। ক্ষোভ ঝরে পড়ে তাঁর কথায়। ” একটা রাস্তার জন্য বারবার ব্লকে গিয়েছি। কিছুটা রাস্তা ঢালাই হয়েছিলো। কিন্তু এতটাই খারাপ কাজ যে বর্ষায় তা সাফ হয়ে গিয়েছে। আমরা চাইছি বড়গোড়া যাতে বাঘমুন্ডি, বলরামপুরের সঙ্গে রাস্তার মাধ্যমে যুক্ত হয়। পানীয় জলেরও কোন ব্যবস্থা নেই। এই সমস্যাগুলোর কথাই এসপিকে বললাম। এরপরেও যদি কোন কিছু না হয় তাহলে বিচ্ছিন্ন থাকাই আমাদের কপাল।”
পুলিশ সুপারের আজকের অতর্কিত পরিদর্শন নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে পাহাড়িয়া বড়গোড়াকে।
গ্রামের বাসিন্দা নাগর ও হারাধন পাহাড়িয়া বলেন, ” আর কতদিন আমরা ‘দাঁড়ি’-র জল খেয়ে দিন কাটাবো?” গ্রামে রাস্তা নেই বলে গর্ভবতীদের ডুলিতে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। অভিযোগ তোলেন তাঁরা।
১৪ বছর আগে পার্থ বিশ্বাস ও তাঁর সঙ্গী শিক্ষক সৌমজিৎ বসু হত্যার কিনারা করেছিলেন এই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য তখন তিনি এসপি নন। ছিলেন ডিএসপি ( শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ )
স্মৃতিতে ডুব দিয়েছেন নাগর পাহাড়িয়া। ” মাওবাদীরা তখন প্রতিদিন গ্রামে আসতো। করতো মিটিং। আমাকেও মাওবাদী সন্দেহে জেলে থাকতে হয়েছিল। “
এদিন পুলিশের আস্থার সঙ্গে ছিলেন একদা মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের সদস্য নন্দ কুমার, তরণী টুডু, পার্বতী টুডু, জলধর সিং সর্দারের মতো রাজ্য পুলিশের স্পেশাল হোমগার্ডরা। ছায়া থাকলে আলোও থাকবে। সেই আশার আলো কি এই আস্থায় আলোকিত করবে বড়গোড়াকে? ‘আস্থা’ দিয়ে ভরসার হাত পুলিশ সুপারের।
Post Comment