সম্রাট নাগ, পুরুলিয়া:
‘আস্থা’ প্রকল্পে অযোধ্যা পাহাড়ের সামগ্রিক উন্নয়নের কাজ এবার স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই
রূপায়িত হবে। পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সম্প্রতি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে গত শুক্রবার অযোধ্যা ফাঁড়িতে অযোধ্যা পাহাড়ের গ্রামবাসীদের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই বৈঠকেই পুরুলিয়া জেলা পুলিশ জানিয়ে দেয়, তাদের ‘আস্থা’ প্রকল্পের কাজ এবার এখানকার মানুষজনদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই হবে। সেই কারণেই ওই বৈঠকে অযোধ্যা পাহাড়ের
৭০টি গ্রাম থেকে আসা একজন করে প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অযোধ্যা আদিবাসী উন্নয়ন কমিটি তৈরি হয়। গত ২ বছর ধরে পুরুলিয়া জেলা পুলিশের এই ‘আস্থা’ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে নানান উন্নয়নমূলক কাজ চলছে অযোধ্যা পাহাড়ের গ্রামগুলিতে। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আস্থা প্রকল্পকে কার্যকর করতে আমাদের যেমন খাটিয়া বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে। তেমনই এই প্রকল্পের মধ্যে আমাদের জনসংযোগ কর্মসূচিও চলছে। আমরা ঠিক করেছি এই প্রকল্পের সমস্ত কাজ গ্রামবাসীদের মতামতের মাধ্যমে রূপায়িত হবে। একেবারে আলোচনার মধ্য দিয়ে। সেই লক্ষ্যেই আমাদের বৈঠক হলো।”
ওই আদিবাসী উন্নয়ন কমিটিতে পাহাড়ের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। ওই কমিটির অধীনেই একজন সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদ তৈরি করার প্রস্তাব দিয়েছে
পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। কারণ আদিবাসীদের সংস্কৃতি নজরকাড়া। সেই সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার ঘটাতেই ওই প্রস্তাব। ওই বৈঠক থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের মানুষজন শপথ নেন তাদের উন্নয়ন কার্যকলাপে তারা কোন বহিরাগত মানুষজনদের কথা শুনবেন না।
আগে এই পাহাড় ছিল কার্যত মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। এই পাহাড়েই ছিল তাদের ডেরা। সেই সময় খুন, নাশকতা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এখন অবশ্য দিন বদলেছে। রাজ্যে পালা বদলের পর ঝাঁ চকচকে রাস্তা হয়েছে। হয়েছে কালভার্ট। গড়ে উঠেছে সুসজ্জিত পর্যটনের পরিকাঠামো। এই পর্যটন থেকে পাহাড়ের স্থানীয় মানুষজন আয় করছেন। এই কাজকে আরও ত্বরান্বিত করতে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ
পাহাড়ের বাসিন্দাদেরকে
হোম স্টে প্রকল্পে আরও বেশিভাবে যুক্ত করবে। যাতে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপকভাবে বদল ঘটে। এই হোম স্টে-র পাশাপাশি এই কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে
সবরকম ভাবে সাহায্য করবে পুলিশ। এই পাহাড়ে ব্যাপক হারে টমেটোর ফলন হয়। কিন্তু তার দাম পান না পাহাড়ের কৃষকরা। ওই কৃষকরা যাতে সঠিক দাম পান তার ব্যবস্থা করবে পুলিশ। পুরুলিয়া শহরে যাতে তারা বিক্রি করতে পারেন সেই আশ্বাস দেওয়া হয়। পাহাড়ের বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রাম যেমন উত্তর অযোধ্যার জিলিংসেরঙ, মামুডি, লেওয়া, তেলিয়াভাসা, পিটিডি, দক্ষিণ অযোধ্যার বড়গোড়া, হেদেলবেড়া, ধানচাটানি, ছাতরাজেরা, উসুলডুঙরি, পুনিয়াশাসন শিমূলবেড়া, সিলিংদা, পূর্ব অযোধ্যা থেকে বামনি, ঘাটিয়ালি, সাপারমবেড়া, সোনাহারা, সাহারজুড়ি ও পশ্চিম অযোধ্যার বারুয়াজেড়া, বাঁধঘুটু, সেরামচাকি,
টারপানিয়া, রাঙা গ্রামের মানুষজন ওই বৈঠকে আসেন। বাঁধডি গ্রামের শিবনাথ বেশরা, রাঙা গ্রামের ধীরেন মুর্মু বলেন,” আমাদের উন্নয়নমূলক কার্যকলাপে পুলিশ সবরকম ভাবে সাহায্য করছে। আমরা ভীষণই খুশি। খুব সহজেই আমরা সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা গুলো পাচ্ছি।” এই কাজে আগে থেকেই যুক্ত রয়েছেন মাওবাদীরা। যারা এখন রাজ্য পুলিশের স্পেশাল
হোমগার্ড। এই পাহাড়ে কোথায় কি সমস্যা তা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে তারাও তালিকাভুক্ত করছেন। তরণী টুডু, পশুপতি মুর্মু, জলধর সিং সর্দার, পার্বতী টুডু, চম্পা সোরেন, শিখা মুর্মুর মত একসময় আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীরা পাহাড়ের গ্রাম ঘুরে ঘুরে নজর রাখছেন কি সমস্যা। তারপর জানিয়ে দিচ্ছেন জেলা পুলিশের কর্তাদের।
মূলত পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে এই পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে রাজ্যের জনমুখী প্রকল্প গুলিকে একশো শতাংশ কার্যকর করা হচ্ছে।
আসলে অতীতে তিনি পুরুলিয়া জেলা পুলিশের ডিএসপি ( শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) ও রঘুনাথপুর মহকুমা পুলিশ আধিকারিক থাকার কারণে এই জেলাকে হাতের তালুর মত চেনেন। বিশেষ করে অযোধ্যা পাহাড়ের ৭০ টি গ্রামের অবস্থান। সেই সঙ্গে তার রাস্তাঘাট, ভৌগোলিক এলাকা তাঁর নখদর্পণে। শুধু তাই নয় পাহাড়ের ওই প্রত্যন্ত গ্রামগুলির সঙ্গে তার নিরন্তর যোগাযোগ। সেই কারণেই পুরুলিয়া জেলা পুলিশের ‘আস্থা’ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলি
ঘরের দুয়ারে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে। গত ২ বছরে প্রায় ৫০ টির বেশি অযোধ্যা পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে খাটিয়া বৈঠক করে জনসংযোগের ভিতকে মজবুত করেছে পুলিশ। তবে শুধু অযোধ্যা পাহাড় নয় একদা মাওবাদী উপদ্রুত বান্দোয়ানেও ‘আস্থা’ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বনবাসীর আস্থা অর্জন করে নিয়েছে পুলিশ। আসলে ‘মাওবাদী’ শব্দটাই যে এখন জঙ্গলমহলে অতীত। একদিকে রাজ্যের জনমুখী প্রকল্প। সেই সঙ্গে পুরুলিয়ার মত জেলায় এই পুলিশ সুপার যিনি তৎকালীন ডিএসপি তাঁর নেতৃত্বে একের পর এক অপারেশন মাওবাদীদেরকে কোনঠাসা করে দেয়। সেই সঙ্গে ওই অতি বামপন্থীদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতেও নিজস্ব নেটওয়ার্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন বর্তমান পুলিশ সুপার অভিজিৎ। তাই এই জঙ্গলমহলে আর কেউ বিপথে পরিচালিত হন না। তাই আক্ষরিক অর্থেই অযোধ্যা পাহাড়ের মানুষজন
পুলিশকে বন্ধু পাতিয়ে নিয়েছেন। আর এরই সুফল
মিলছে পাহাড়ের ঘরে ঘরে।
Post Comment