দেবীলাল মাহাত, আড়শা:
দোরগোড়ায় ‘বাঁদনা’ বা ‘সহরায়’ পরব। সেজে উঠেছে সাবেক মানভূম। গ্রামে-গঞ্জে লেগেছে রঙের ছোঁওয়া। মহিলাদের হাতের কারুকাজে সেজে উঠছে মাটির দেওয়াল। মাটির দেওয়ালকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই পরবের আনন্দ। মূলত প্রাকৃতিক রঙেই এই পরবে সাজিয়ে তোলা হয় মাটির দেওয়াল। আধুনিকতার যুগে আজও অমলিন প্রাকৃতিক রঙ। ফলে দেওয়াল হয়ে ওঠে এক একটি ক্যানভাস। যাকে বলা হয় ‘দেওয়াল চিত্র।’
এই দেওয়াল চিত্রের ধারক ও বাহক মহিলারা। আধুনিকতার যুগে আজও তারা ধরে রেখেছেন এই ঐতিহ্য। মহিলারা মাঠ, চাষের জমি থেকে চুনামাটি , খড়ি মাটি, পলিমাটি সহ বিভিন্ন ধরনের মাটি সংগ্রহ করেন। মাটিতে মিশিয়ে দেন গোবর। এরপর শুকোতে হয় দেওয়াল। তারপর দেওয়া হয় খড়িমাটি । এরপর প্রাকৃতিক রং দিয়ে সেই সাদা দেওয়ালে নানা রকম নকশা ও গাছপালা আঁকেন। এই দেওয়াল চিত্র অন্য মাত্রা এনে দেয় ‘বাঁদনা’ ও ‘সহরায়’ পরবে। এই পরবের সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। সেই কারনেই প্রকৃতি থেকেই রং সংগ্রহ করে থাকেন মহিলারা। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ধরে রাখে তাদের সৃজনশীলতা। কালো-কাঠ, টায়ার, খড় পোড়ানো ছাই, ভুসাকালি থেকে হয় কালো রঙ।
লাল গেরু মাটি থেকে হয় লাল। আলয় মাটি, বনক মাটি বা হলুদ থেকে হয় হলুদ।
খড়ি মাটি বা কলি চুন থেকে হয় সাদা। নীল বড়ি ,জামা কাপড় দেওয়ার নীল থেকে নীল। আর সীমের পাতা থেকে সবুজ। এছাড়া গেরুয়া ও নীল রং মিশিয়েও করা হয় সবুজ। দেওয়াল চিত্রে তুলির ব্যবহার একেবারেই নেই। আঙুলের ডগায় কাপড় জড়িয়ে রঙ করাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ মহিলারা । শাল, খেজুর, ডালকে থেঁতলে তুলির কাজ করা হয়। পরবের দিন উঠোন জুড়ে, সুন্দর করে দেওয়া আলপনা। যাকে বলা হয় ‘চোকপুরা’ । সাধারণত পাইনা লতা , ঢেঁড়শ গাছ, গামার পাতা থেঁতলে , চালের গুঁড়া সাথে মিশিয়ে
চোকপুরার উপাদান তৈরী করা হয়। কাশিপুর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাত বলেন, “লোকশিল্পের অনন্য নিদর্শন আলপনা, দেওয়াল চিত্র। আদিম যুগে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াতের সময় দেওয়াল চিত্র দেখে বোঝা যেত সেই পরিবারটি কোন গোত্রের। কোন কোন গোত্রের মানুষের বসবাস গ্রামে।” তবে এই আধুনিকতার যুগেও মহিলারা কোনো রাসায়নিক রঙ ব্যবহার করেন না। তবুও দেওয়াল করে তোলে রঙিন। দেওয়ালে নিজস্ব শৈলীর চিরাচরিত চিত্র। আর উঠোনে
চোকপুরার নান্দনিক সৌন্দর্য। উভয়ের মিশ্রনে পরবকে করে তোলে আরও রঙিন।আর রঙিনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের সংস্কৃতির পরিচয়।
Post Comment