insta logo
Loading ...
×

অহিরা গীত ও কৃষিজীবী কুড়মি জনগোষ্ঠীর জীবনদর্শন

অহিরা গীত ও কৃষিজীবী কুড়মি জনগোষ্ঠীর জীবনদর্শন

সনতা মাহাতো
লোকগবেষক
আড়ষা, পুরুলিয়া
যোগাযোগ- ৮৯৭২৬০৮৫৭০
ই-মেইল- sanatamahato570@gmail.com

মানভূমের উৎসবগুলির মধ্যে জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত উৎসব ‘বাঁদনা’ । ‘বাঁদনা’ পরব
হল পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম সহ প্রাচীন ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের এবং সীমান্ত বাংলার মানুষের অন্যতম প্রধান উৎসব। এই অঞ্চলগুলির মানুষ জল, জঙ্গল, এবং জমিকে কেন্দ্র করে জীবনযাপন করেন। তাদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। চাষবাস ও কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। যার ফলে কৃষি-ভিত্তিক সংস্কৃতিকে ঘিরেই তাদের সারা বছরের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ, উৎসব-মেলা এবং সংস্কারগুলো পালিত হয়। ‘বাঁদনা পরব’ মূলত এই কৃষি সংস্কৃতির অংশ। যেখানে গবাদি পশু যেমন গরু ও মহিষ এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির বন্দনা করা হয়।
‘বাঁদনা’ পরবের গান বা গীতই হল অহিরা গান। অহিরা গান ‘সঁহরই’ গীত বা ‘সহরই’ গীত বা ‘সেঁহেরই’ গীত নামেও পরিচিত। বাঁদনায় গো বন্দনাই প্রধান। ছোটনাগপুর অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ তার নিজস্ব আচার রীতিতে এই বন্দনা সম্পন্ন করেন। ছোটনাগপুরের কুড়মি জনগোষ্ঠী সহ অন্যান্য হিতমিতান জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ‘বাঁদনা’ পরব বা ‘সঁহরই’ পরব যথাযথ রীতি অনুযায়ী বর্তমানেও ধারাবাহিকভাবে সমানে পালন করে আসছে। গোপালক বা রাখাল বা বাগালদের গো-বন্দনার গান হল অহিরা। অহিরা গান একান্তভাবেই কুড়মি সম্প্রদায়ের সৃষ্ট এবং কুড়মালি ভাষাতেই প্রথম রচিত হয়।
অহিরা গানের মূল বিষয় হল বাস্তব কাহিনি, বাস্তব বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা। এতে কল্পনার স্থান নেই, বরং সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনের নর-নারী-ই এর কেন্দ্রবিন্দু। এই গানগুলিতে সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের কথা সহজ, সরল ভাষায় প্রকাশ করা হয়। শুধু মানুষ নয়, এই গানে পশুপাখি, গাছপালার কথাও উঠে আসে। অহিরা গানের বিষয়বস্তুর মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। যেখানে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের কৃষিজীবী-আদিবাসী সমাজের বাস্তব সংসারের নানা খুঁটিনাটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই গানের মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই অহিরা গানের প্রধান লক্ষ্য। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে পরিবারের বা সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিক কতটা জানে, তা যাচাই করা হয়, এবং পরে তাদের সেই প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দেওয়া হয়। এটি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের একটি পদ্ধতি। অহিরা গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ‘সহরই গীত’ নামে পরিচিত গানগুলি। এই বহুমাত্রিক গানগুলি ‘বাঁদনা বা ‘সহরই’ পরবের মূল তাৎপর্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরে এবং কৃষিজীবী, শ্রমজীবী সমাজের মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক স্মরণ করিয়ে দেয়।

গরু-মোষের যত্ন নেওয়ার প্রসঙ্গে অহিরা গান কিষাণদের স্মরণ করিয়ে দেয় বছরে একবার অনুষ্ঠিত হওয়া গো-বন্দনা বা বাঁদনা পরবের কথা। যা গরু-মোষদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অহিরে—
“নিরন মাসে গেইআ ছপলি চরলউ বাবু হউ
রপা মাসে লেলউ গুটিআই।
ভাদর জে মাসে গাই কচি ঘাসঅ ভাঁগতউ
কাটেইন আশা লেউ দুবাধান।”

গ্রীষ্মকালে গরু-মোষকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চরাতে দেওয়া হয়, কিন্তু রপা মাস অর্থাৎ চাষের সময় তাদের একসঙ্গে এক জায়গায় চরাতে হয়। ভাদ্রমাসে খেত-খামারের কচি ঘাস কেটে খাওয়ানো হয়, আর কার্তিক মাসে ধান ও দুর্বা দিয়ে তাদের বন্দনা করা হয।
মেয়েরা অপেক্ষা করে ভাদ্রমাসে করম পরবের জন্য আর গরু অপেক্ষা বাঁদনা বা সহর-ই
পরবের জন্য। সুতরাং কার্তিক মাসের অমাবস্যায় বাঁদনা পরব পালন করা সকলের অবশ্য কর্তব্য।
কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে গরুর শিঙে তেল লাগিয়ে বাঁদনা পরবের সূচনা হয়। চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয় ঘাউআ, আর অমাবস্যার রাতে গীত গেয়ে সারারাত জাগরণ করা হয়। প্রতিপদ তিথিতে গরুকে দুব ঘাস ও নতুন ধানে চুমানো হয়। এরপর কিছুক্ষণ গরুর পালক এবং রাখালরা সারা বছরের সুখ-দুঃখ নিয়ে গান করে। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই নিজ নিজ আখড়ায় একত্রিত হয় এবং যতক্ষণ ঘুম না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঢোল, ধামসা, মাদলের তালে গানের অনুশীলন চলে।
সন্ধ্যায় চাঁদ ওঠে, সকালে সূর্য উঠে। আর মাঝরাতে জাগে গাই, তার বাচ্চাকে দেখতে। ভোরের আগে, যাকে ভিনসার বলে। কিষাণকে জাগতে হয় এবং গরু-মোষকে খড় দিয়ে যত্ন নিতে হয়। সকালে মাঠে যাওয়ার আগে তাকে নিশ্চিত করতে হয় যে গরু-মোষ সুস্থ আছে কিনা। অন্যদিকে নারীর জীবনে তার মা, বাবা, ভাই ও স্বামীর গুরুত্ব কতখানি
সেটাও তুলে ধরা হয়েছিলো অহিরা গানে।
অহিরে— “কনে জে দেতউ ভালা ঝিলিমিলি সাড়ি রে বাবু হউ কনে ত দেতউ ধেনু গাই ।
কনে জে দেতউ ভালা দিঅ কানে সনা গউ
কনে দেতউ সিঁথেকে সিঁদুর।”

অহিরে-
“মাঞে জে দেতউ ভালা ঝিলিমিলি সাড়ি রে বাবু হউ
বাপে ত দেতু ধেনু গাই।
দাদাঞ জে দেতউ ভালা দিঅ কানে সনা গউ
সঞাঞ দেতউ সিঁথেকে সিঁদুর।”

মা মেয়েকে রংবেরঙের শাড়ি দেবে, বাবা দেবে দুধেল গরু, দাদা বোনকে অলংকারে সাজিয়ে দেবে, আর স্বামীর কাছ থেকে সে পাবে সিঁথিতে সিঁদুর।
এইভাবেই অহিরা গান পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে সবার পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নির্ভরশীলতাকে তুলে ধরে এবং পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় রাখতে শেখায়।
কৃষিজীবী-শ্রমজীবী মানুষের অভিজ্ঞতা এবং দৈনন্দিন জীবনের উপলব্ধির মধ্য দিয়ে এই সত্য প্রকাশিত হয়েছে যে, পিতার মৃত্যুতে মানুষ নাবালক হয়ে যায়। মায়ের মৃত্যুতে সে অনাথ হয়ে পড়ে। ভাইয়ের মৃত্যুতে বাহুবল হারায়। আর অসময়ে স্ত্রী চলে গেলে সমস্ত সংসার শূন্য হয়ে যায়। সুখের সংসার মুহূর্তেই গভীর বেদনায় পরিণত হয়। সাংসারিক জীবনের এই অসহায় দিকটি যে শিক্ষা এবং গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে তা একেবারেই অনন্য।
অহিরা গানের মাধ্যমে কৃষিজীবী মানুষের জীবনদর্শন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। এই গানে বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিমান, আশা-নিরাশার পাশাপাশি মানব জীবনের নশ্বরতার বিভিন্ন দিকও তুলে ধরা হয়েছে।

মরণশীল মানুষ কখন মরবে, তা কেউ জানে না। একবার মারা গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। কিন্তু পালা-পার্বনগুলি প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে বারবার ফিরে আসে। অমাবস্যার রাতে গাই জাগাতে আসা লোকেরা গৃহস্থের কাছে এই বাস্তব সত্যটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
এইভাবে দেখা যায়, জগৎ ও জীবনের বাস্তব সত্য ও জ্ঞান সুরেলা অহিরা গীতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। শ্রমজীবী কৃষক এবং মেহনতী নিরক্ষর মানুষও গো-পূজার তাৎপর্য, সংসারে নিজের কর্তব্য এবং জীবনের সার সত্যকে জানে। প্রথাগত শিক্ষার জগত থেকে বহু দূরে অবস্থানকারী এই মানুষগুলি বংশ পরম্পরায় তাদের ঐতিহ্যকে লালন-পালন করে উত্তর পুরুষের কাছে হস্তান্তর করে চলেছে। এভাবে তারা তাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করেছে।

(লেখকের মতামত নিজস্ব)

Post Comment