সুইটি চন্দ্র ও প্রেম দত্ত, পুরুলিয়া :
“শুন বিহারী ভাই / তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই…”— ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে পুরুলিয়ার মাঠে-মাঠে, গ্রামে-গঞ্জে প্রতিধ্বনিত হতো এই টুসু গান। লোকসেবক সংঘের সদস্য ও প্রয়াত সাংসদ ভজহরি মাহাতোর লেখা এই গান ছিল আন্দোলনের সাহস আর লড়াইয়ের মন্ত্র। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬— টানা নয় বছর ধরে ভাষা আর ভূখণ্ড রক্ষার লড়াইয়ে উত্তাল ছিল সাবেক মানভূম। তারও আগে, ১৯১২ সাল থেকেই মানভূমকে বাংলায় ফেরানোর দাবিতে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। সেই লড়াইয়ের ফলেই ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর বিহার থেকে বাংলায় মানভূম জেলা ভেঙে অন্তর্ভুক্ত হয় পুরুলিয়া— প্রতিষ্ঠা পায় জেলার, বলা চলে জন্ম হয় নতুন পুরুলিয়ার।
সত্তর বছরে ফিরে এল ক্ষোভের কালো দিন
এত কিছুর পরেও বছর ঘুরে ১ নভেম্বর এলেই পুরুলিয়ার একাংশ মনে করেন এ দিন আনন্দের নয়, বঞ্চনার। তাই প্রতি বছরের মতো এবছরও শনিবার ‘কালা দিবস’ পালন করল মানভূম সংস্কৃতি রক্ষা কমিটি ও আদিবাসী কুড়মি সমাজ। কালো ব্যানার, পোস্টার হাতে মিছিল শহর চষে বেড়ালো। পরে জেলা শাসকের দপ্তরের বাইরে অবস্থান-বিক্ষোভে বসেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের দাবি— ভাষার অজুহাতে মানভূমের খনিজ সম্পদ ও সংস্কৃতিকে তছনছ করার পরিকল্পনাতেই মানভূম জেলার ভাঙন ঘটিয়ে পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। তাই পুরুলিয়ার পুরনো নাম— ‘মানভূম জেলা’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি তুললেন তাঁরা।
আদিবাসী কুড়মি সমাজের মুখ্য উপদেষ্টা অজিত প্রসাদ মাহাতোর অভিযোগ, “ভাষা নয়, আসল উদ্দেশ্য ছিল মানভূমের সম্পদ দখল। তাই আজও আমাদের দাবি— পুরুলিয়াকে তার ইতিহাসের আসন ফিরিয়ে দাও।”
বিপরীত স্বরও উঠল— “বঞ্চনা ঠিক, কিন্তু কালো দিবস কেন?”
ভাষা আন্দোলনের সময় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল যে সংগঠন, সেই লোকসেবক সংঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো অবশ্য তীব্র প্রশ্ন তুলেছেন এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁর কথায়, “বঙ্গে অন্তর্ভুক্তির সময় পুরুলিয়ার সঙ্গে বঞ্চনা হয়েছে ঠিকই। বাংলাভাষীর সংখ্যাই ছিল বেশি মানভূমে। অথচ ষড়যন্ত্র করে বোকারো, ধানবাদ, জামশেদপুর— এই শিল্পাঞ্চলগুলি বিহারের হাতে রাখা হয়। পরে ঝাড়খণ্ডে গিয়ে জুড়ে যায়। সেখানে তো আজও বাংলাভাষীরা ভাষার অধিকার পেলেন না। তাহলে সেখানে কালা দিবস হয় না কেন?”
তার পরেই সুশীলবাবুর স্পষ্ট অভিযোগ— “আজ যারা কালা দিবস পালন করছে, তাঁদের উদ্দেশ্য ইতিহাস রক্ষা নয়, বরং এই অঞ্চলকে ঝাড়খণ্ডে যুক্ত করার স্বপ্ন।”
ইতিহাসের পথ, ভাষার গাথা, প্রশ্নের মুখে পরিচয়
তৎকালীন বিহারে বাংলা ভাষার সঙ্গে বিমাতৃ সুলভ আচরণ করা হতো। হিন্দি ভাষায় পঠন পাঠন জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে বলে অভিযোগ। ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল— পুঞ্চার পাকবিড়রা থেকে কলকাতা পর্যন্ত ১০০০-এর বেশি ভাষা সত্যাগ্রহীদের পদযাত্রা ছিল ইতিহাসের নজির। বৈশাখের দহনজ্বালা উপেক্ষা করে মাতৃভাষা-রক্ষা আর বঙ্গভুক্তির দাবিতে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও। সংখ্যাটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ইতিহাস মানে, ওই পথেই জন্ম নিয়েছিল এক নতুন পুরুলিয়া— বাংলা মাটির সন্তান হিসেবে।
আজ সেই অন্তর্ভুক্তির সত্তর বছরে প্রশ্ন যতটা ভাষার, ততটাই পরিচয়ের। কালো কাপড় জড়ানো ব্যানারে লেখা ক্ষোভ, আর বুকপকেটে গোঁজা টুসু গানের সুর যেন একসঙ্গে শোনায়— “মাটির টান ভুলিস না, ভাষার মান রাখিস।”
পুরুলিয়া আবারও দাঁড়িয়ে সড়কের দুই পাশে— এক পাশে বঞ্চনা-অভিমান, অন্য পাশে ইতিহাস আর বাংলা মাটির মমতা।










Post Comment