insta logo
Loading ...
×

আঙুল হয়ে ওঠে তুলি, প্রকৃতি সাজায় রঙ, বাঁদনায় রঙিন পুরুলিয়া

আঙুল হয়ে ওঠে তুলি, প্রকৃতি সাজায় রঙ, বাঁদনায় রঙিন পুরুলিয়া

দেবীলাল মাহাত, আড়শা:

সাবেক মানভূম তথা বৃহত্তর ছোটনাগপুরে কৃষিজীবি মানুষের প্রাণের উৎসব পরব’ বাঁদনা’। আর বাঁদনা পরবের প্রাণ হল অহিরা গীত । তেমনি এই পরবের শিল্প হল মাটির দেওয়ালে বিভিন্ন প্রাকৃতিক রঙে আঁকা ছবি। সেই ছবিতে ফুটে ওঠে প্রকৃতি,পশু,পাখি ,ফুল সহ কৃষি জীবন ,সমাজ জীবনের ছবি। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক রঙে মহিলারা সাজিয়ে তোলেন মাটির দেওয়াল। মহিলাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায়,এই সময় মাটির দেওয়ালগুলো যেন খুঁজে পায় তাদের প্রাণ। মাটির দেওয়ালকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে যেন এই পরবের আনন্দ। আধুনিকতার যুগে আজও অমলিন প্রাকৃতিক রঙ।এর ফলে দেওয়াল হয়ে ওঠে এক একটি ক্যানভাস। যাকে বলা হয় ‘দেওয়াল চিত্র।’ সেই দেওয়াল চিত্র চোখ টানে সকলের। দেওয়াল চিত্রের অপরূপ সৌন্দর্য জানিয়ে দেয় সাবেক মানভূমের বুকে ‘বাঁদনা’ আসন্ন।

দেওয়াল চিত্রের ধারক ও বাহক মহিলারা। আধুনিকতার যুগে আজও ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্য। তুলি থেকে রং সবকিছু মহিলারাই তৈরি করেন। মহিলারা মাঠ , চাষের জমি থেকে চুনা মাটি ,খড়ি মাটি ,পলিমাটি সহ বিভিন্ন ধরনের মাটি সংগ্রহ করেন। সেই মাটিতে মিশিয়ে দেন গোবর। দেওয়ালে দেওয়ার পর তা দেওয়া হয় শুকোতে। তার উপরে দেওয়া হয় খড়ি মাটি । এরপর প্রাকৃতিক রং দিয়ে সেই সাদা দেওয়ালে নানা রকম নকশা ও গাছপালা আঁকেন। এই দেওয়াল চিত্র ই অন্য মাত্রা এনে দেয় বাঁদনা ও সহরায় পরবে।পরবের সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক ।সেই কারনেই প্রকৃতি থেকেই রং সংগ্রহ করে থাকেন মহিলারা। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ধরে রাখে তাদের সৃজনশীলতা। কালো- কাঠ,টায়ার,খড় পোড়ানো ছাই,ভুসাকালি থেকে কালো। লাল – গেরু মাটি থেকে লাল। হলুদ – আলয় মাটি,বনক মাটি বা হলুদ থেকে হলুদ। সাদা- খড়ি মাটি বা কলি চুন থেকে সাদা। নীল- নীল বড়ি ,জামা কাপড় দেওয়ার নীল থেকে নীল।
সবুজ -সীমের পাতা থেকে সবুজ। গেরুয়া ও নীল রং মিশিয়েও করা হয় সবুজ।

দেওয়াল চিত্রে তুলির ব্যবহার একেবারেই নেই। আঙুলের ডগায় কাপড় জড়িয়ে রং করাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ মহিলারা। শাল, খেজুর ডালকে থেঁতলে তুলির কাজ করা হয়। পরবের দিন উঠোন জুড়ে, সুন্দর করে দেওয়া আলপনা। যাকে বলা হয় ‘চোক্ পুরা’ । সাধারণত পাইনা লতা ,টেঁড়শ গাছ, গামার পাতা থেঁতলে , চালের গুঁড়া সাথে মিশিয়ে চোক্ পুরার উপাদান তৈরী করা হয়। কাশিপুর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক -ডঃ ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাত বলেন – লোকশিল্পের অনন্য নিদর্শন আলপনা, দেওয়াল চিত্র। আদিম যুগে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াতের সময় দেওয়াল চিত্র দেখে বোঝা যেত সেই পরিবারটি কোন গোত্রের বা গুষ্টির। কোন কোন গোত্রের মানুষের বসবাস গ্রামে। তবে তিনি জানান নগরায়নের ফলে দিনদিন কমে আসছে মাটির ঘরের দেওয়াল। ফলে হারিয়ে যেতে পারে আদিম লোককলা শিল্পটি ।

সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের অধ্যাপক তথা কুড়মালি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডঃ সনৎ কুমার মাহাত বলেন, “তুলি থেকে রং সবকিছু মহিলারাই তৈরি করেন । রাসায়নিক কোনো কিছুই এই পরবে থাবা বসাতে পারেনি। বাঁদনা পরবের এটাই নিজস্বতা। যা আজও বিদ্যমান।”

বামুনডিহা গ্রামের সুগা মাহাত, তুম্বাঝালদা গ্রামের মৌসুমী মাহাত বলেন, “সারা বছর ধরে আমরা বাঁদনা পরবের অপেক্ষায় থাকি । এই সময়েই বিভিন্ন রঙ দিয়ে ঘরকে সাজিয়ে তুলি । নবীন প্রজন্মের মেয়েরাও যে আদিম লোককলা শিল্পটিকে ধরে রাখতে চায়, তা স্পষ্ট নবম শ্রেণীর ছাত্রী চুমকি মাহাত, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সোনালী মাহাতোদের কথায় । তাদের স্পষ্ট জবাব, “আমাদের সংস্কৃতি , আমাদের পরিচয় । তাই বাঁদনা পরব এলেই, আমরাও মা, কাকিমাদের সাথে ঘরকে সাজিয়ে তোলার কাজে হাত লাগাই । এই কাজে আমরা কোনো খামতি রাখি না।”

আধুনিকতার যুগে মহিলারা কোনো রাসায়নিক রং ব্যবহার না করেও দেওয়াল করে তোলে রঙিন। দেওয়ালে নিজস্ব শৈলীর চিরাচরিত চিত্র, আর উঠোনে চক্ পুরার নান্দনিক সৌন্দর্য। উভয়ের মিশ্রনে পরবকে করে তোলে আরও রঙিন। আর রঙিনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের সংস্কৃতির পরিচয়।

Post Comment