insta logo
Loading ...
×

শ্রীরামের পথে কাশিপুরে অকালবোধন, শুরু ষোল দিনের দুর্গাপূজা

শ্রীরামের পথে কাশিপুরে অকালবোধন, শুরু ষোল দিনের দুর্গাপূজা

নিজস্ব প্রতিনিধি, কাশিপুর:

আজ ভাদুর জাগরণ। আগামীকাল বিশ্বকর্মা পূজা। তার আগেই কাশিপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারে শুরু হয়ে গেল দুর্গা আরাধনা। তিথি-নক্ষত্রের মিলনেই যেন ঘটে গেল এক বিরল অকালবোধন। জিতা অষ্টমীর পরের দিন, কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি, ভদ্রা নক্ষত্রের আলোর ছায়ায় সোমবার সকাল থেকে রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালান জেগে উঠল ঢাকের বাদ্য, মন্ত্রোচ্চারণ, আগমনী গান ও বলিদানের মাধ্যমে।

এমন পুজোর সময়কাল কিন্তু বেশ অদ্ভুত। মহালয়ার জন্য অপেক্ষা আরও পাঁচ দিন। দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী আসতে বাকি আরও বারো দিন। কাশিপুর রাজবাড়িতে হয়নি ভাদুর পূর্ণ জাগরণ। হয়নি বিশ্বকর্মার আরাধনা। অথচ তার আগেই দেবী দুর্গার আবাহন পঞ্চকোট রাজপরিবারে।

রাজপরিবারের বর্তমান সদস্য, মহারাজাধিরাজ নীলমণি সিং দেও-র প্রপৌত্র সৌমেশ্বরলাল সিং দেও জানালেন, “আমাদের পুজো সম্পূর্ণ তিথি-নক্ষত্র নির্ভর। শকাব্দ ২ থেকে এই কুলাচার চলে আসছে। শ্রীরাম যেমন রাবণ বধের আগে দুর্গাদেবীর অকালবোধন করেছিলেন, আমাদের পুজোও সেই রীতি অনুসারেই হয়।”

ভাদ্রের কৃষ্ণা নবমী তিথিতে অকাল বোধন করেছিলেন শ্রীরাম। সেই রীতি মেনে এখানেও এদিনই শুরু হয়ে যায় ষোড়শ কল্পের পুজো। অন্যবার পুজো আশ্বিনের শেষে বা কার্তিকে পড়লে বিশ্বকর্মা পুজোর পরেই পড়ে তিথিটি। কিন্তু এবার পুজো একেবারে সেপ্টেম্বরের শেষে। ফলে কাঙ্ক্ষিত তিথি পড়েছে বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই।

এখানকার দেবী শিখরবাসিনী দুর্গা। রাজপরিবারের কুলদেবী। অষ্টধাতুর তৈরি এই প্রতিমা চতুর্ভুজা। এক হাতে জপমালা, অন্য হাতে বেদ। বাকি দুই হাতে বরদান ও অভয়। পদ্মাসনে আসীন দেবী গলায় ধারণ করেছেন নরমুণ্ডমালা। এই প্রতিমার আরাধনাই চলে টানা ষোল দিন ধরে। পুজোর পরিচিত নাম ষোল কল্পের দুর্গাপুজো । রয়েছে বহুযুগের ইতিহাস। ধারনগরের মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর জগদ্দেও সিং দেও-র কনিষ্ঠ পুত্র দামোদরশেখর সিং দেও বাহাদুর চাকলা পঞ্চকোট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় থেকেই কুলাচার অনুযায়ী শিখরবাসিনী দুর্গার পূজা শুরু হয়। দামোদরশেখরের নাম অনুসারেই এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহল পরিচিত হয় ‘শিখরভূম’ নামে। সেখান থেকেই দেবীর নাম ‘শিখরবাসিনী’।

রাজপরিবার যেখানেই রাজধানী সরিয়েছে—গড়পঞ্চকোট, পাড়া, কেশরগড় বা কাশিপুর—সেখানেই ধুমধাম করে শিখরবাসিনী পূজিতা হয়েছেন। বর্তমানে দেবোত্তরের সেবাইত বিশ্বজিৎপ্রসাদ সিং দেও-র তত্ত্বাবধানে পূজা পরিচালিত হয়।

এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভোগ নিবেদন। প্রতিদিন দেবীর কাছে নিবেদন করা হয় বিশেষ ভোগ, তবে যেই থালায় ভোগ নিবেদন হয়, সেই থালার ভোগ কেবলমাত্র ‘দেওঘরিয়া’-রা খেতে পারেন। রাজপরিবারের সদস্যরা সেই থালা থেকে খাবার গ্রহণ করতে পারেন না। এটি বহু পুরনো রীতি। সোমবারও দেখা গেল সেই ছবি। বলিদান শেষে মায়ের নিবেদিত বড় থালাটি সামনে রেখে এক দেওঘরিয়া ভোগ গ্রহণ করছেন। তাঁর কথায়, “মায়ের কাছে নিবেদন করা থালা থেকে পঞ্চব্যঞ্জন সহযোগে খাওয়া কেবলমাত্র দেওঘরিয়াদের জন্য অনুমোদিত। তবে পরে সেই প্রসাদ সবার জন্য বিতরণ হয়।”

বনমালী পণ্ডিত বংশের উত্তরসূরি পুরোহিত গৌতম চক্রবর্তী এই পুজো পরিচালনা করেন। তাঁর মতে, “রাজরাজেশ্বরীই আসলে কল্যাণেশ্বরী দেবীর প্রতিমূর্তি। কথিত আছে, মহাঅষ্টমীর সন্ধিক্ষণে দেবী নিজেই এসে রাজপ্রাসাদে পদচিহ্ন রেখে যান। ভূর্জপত্রে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেবী, যতদিন দুর্গাপুজো চলবে, অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে তিনি বিশেষ ভাবে অধিষ্ঠান করবেন এখানে।” এই কারণে এখনও বলা হয়—“মল্লে রা শিখরে পা / সাক্ষাৎ দেখবি তো শান্তিপুরে যা।”

শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জঙ্গলমহলের ইতিহাস, লোকবিশ্বাস, পৌরাণিক আখ্যান। সোমবার বেলা গড়িয়ে যখন ১১টা ৪৭ মিনিট, তখনই রাজপ্রাসাদের পুরনো প্রাঙ্গণে বেজে ওঠে ঢাক। দেবীর আরাধনা শুরু হয় একেবারে প্রাচীন রীতি মেনে। গাছের ছালে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় লেখা ৯টি পত্রে খোদাই করা মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পুজো। এই ‘শ্রীনাদ মন্ত্র’ পাঠের পরেই বাজতে থাকে আগমনী গান—“আজকে পেলাম তোমায় উমা / মনের মাঝে রাখতে চাই…”। একসঙ্গে ধ্বনিত হয় চণ্ডীপাঠ। তার পর বলিদান, প্রদীপজ্বালানো, আরতি। এভাবেই শুরু হয়ে গেল ষোলো দিনের শিখরবাসিনী দুর্গার মহাযজ্ঞ।

Post Comment