নিজস্ব প্রতিনিধি , বান্দোয়ান:
শারদোৎসবের ভিড়ে এক অনন্য ছবি জঙ্গলমহল পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে। ধর্মে ভিন্ন। তবু ঐতিহ্যের রীতিতে মিশে একাকার হলেন থানার ওসি। সাদা ধবধবে ধুতি-গেঞ্জি, কাঁধে লাল গামছা, খালি পায়ে দাঁড়িয়ে হাতে তুলে নিলেন বলিদানের তলোয়ার। না, রক্ত ঝরল না। বরং গামছা দিয়ে মুড়ে দিলেন সেই তলোয়ারকে। শান্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়ল মণ্ডপ থেকে থানার অঙ্গন জুড়ে।
পুরুলিয়ার বান্দোয়ান পুরাতন সর্বজনীন দুর্গাপুজো মণ্ডপে মহাঅষ্টমীর সন্ধিপুজো শেষে গত ৯০ বছর ধরে এই রীতি চলে আসছে। পুজো কমিটির সদস্য অমিত আগরওয়াল বলেন, “আমাদের পুজোয় কোনও দিন প্রাণী হত্যা হয়নি। প্রথম থেকেই চালকুমড়ো ও আখ বলি হয়ে থাকে। লোক বিশ্বাস, বলিদানের পর আমাদের উগ্রতা জেগে ওঠে। সেই উগ্রতাকে প্রশমিত করতেই হয়তো এই রীতি চলে আসছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। যে তলোয়ার দিয়ে বলি হয়, সেই তলোয়ার থানায় নিয়ে যাই। ওসি সাহেব সেটিকে লাল গামছা দিয়ে মুড়ে দেন। তার মধ্য দিয়েই শান্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।”
এবার রীতি আরও অন্য মাত্রা পেল এক কারণে। বান্দোয়ান থানার বর্তমান ওসি শেখ মুমতাজ। ভিন্ন ধর্মের হলেও তিনি নিজে আগ্রহ প্রকাশ করে এই প্রথা পালনে শামিল হন। ধুতি-গেঞ্জি, লাল গামছা পরে খালি পায়ে তিনি রীতির অনুকরণ করলেন। অমিতবাবুর কথায়, “একটাই তো ধর্ম—মানবতা। সেটাই এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।”
ওসি শেখ মুমতাজ বলেন, ” দীর্ঘদিন ধরে এই রীতি পালিত হয়ে আসছে এখানে। যিনি বান্দোয়ানের ওসি হন, তিনিই এই রীতি পালন করেন। আমিও করেছি।”
২০১১ সালে পুরোনো কমিটি ভেঙে গড়ে ওঠে বান্দোয়ান নব দুর্গা সর্বজনীন কমিটি। সেখানেও ১৫ বছর ধরে একই রীতি চলে আসছে। নব দুর্গার সদস্য সঞ্জয় হালদার বলেন, “আমাদের পুজোতেও বলিদানের তলোয়ার থানায় নিয়ে আসা হয়। ওসি নিজে সেটিকে গামছা দিয়ে মুড়ে দেন। উগ্রতা কমানো হয়। ফলে আমাদের পুজোতেও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।”
তিনি আরও জানান, “আমাদের পুজোয় কখনও সাম্প্রদায়িক বিধিনিষেধ ছিল না। এবারের আঁকা প্রতিযোগিতায় যে ছেলেটি প্রথম হয়েছে, সে অন্য সম্প্রদায়ের। আর এবার রীতির কথা জেনে ওসি সাহেব নিজেই জানতে চান, তিনি কি প্রথা পালন করতে পারেন? আমরা বলি, কেন নয়?”
তাঁদের পুজোয় জগজ্জননীকেও পরীক্ষা করার এক অভিনব রীতি রয়েছে। সঞ্জয়বাবুর কথায়, “আমরা মায়ের কাছে ফুল চাই। মা সর্বসমক্ষে সেই ফুল আমাদের হাতে দিয়ে দেন।”
শুধু বান্দোয়ান নয়, আশপাশের গ্রাম থেকেও মানুষ ভিড় জমান এই দৃশ্য দেখতে। একদা মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা। যেখানে এক সময় বন্দুকের ছায়া ছিল, সেখানেই এখন শান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে তলোয়ার মোড়ানো গামছা।
এই শোভাযাত্রার সময় থানার দরজাও খোলা থাকে। কোনও সেন্ট্রি কিছু জিজ্ঞেস করেন না। থানার কঠোরতা মিলিয়ে যায় উৎসবের উষ্ণতায়। আর খাকি উর্দি বা ক্যামোফ্লেজ নয়, সাদা ধুতি-গেঞ্জি, লাল গামছায় অন্য এক রূপে দেখা মেলে ওসির।
পদাধিকার বলে রীতির সঙ্গে জড়িত হলেও, আসল উদ্দেশ্য শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। সেই বার্তা প্রেরণে পুলিশের মানবিক মুখ ফুটে উঠল বান্দোয়ানের পূজায়। এ যেন আইন শৃঙ্খলার কড়াকড়ির বাইরে গিয়ে মানুষ ও পুলিশের দূরত্ব কমানোর এক অনন্য প্রয়াস। একে অনেকে বলছেন—জঙ্গলমহলের এক নতুন পাঠ, কমিউনিটি পুলিশিং-এর সেরা উদাহরণ।











Post Comment