দেবীলাল মাহাত, আড়শা :
সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে অনেক কিছুই। হাতের কাছে চলে এসেছে স্মার্ট ফোন ,টিভি। তাই নবীন প্রজন্মের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে রেডিও। কিন্তু রেডিওকে আজও হাতছাড়া করেননি আড়শা ব্লকের তুম্বাঝালদা গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত হাইস্কুলের শিক্ষক মধুসূদন মাহাত। রেডিও যে তাঁর সবসময়ের সঙ্গী। রেডিওর সাথে তার আত্মিক যোগ। সেই রেডিওকে ঘিরে আজও বাড়িতে বসে প্রবীণ নাগরিকদের আসর। মহালয়ার ভোরে বেজে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে-” আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী । ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা ….।”
মধুসূদন বাবুর পেশা শিক্ষকতা হলেও, নেশা রেডিও শোনা। ৪৫ বছর আগে বাবা কিনে দিয়েছিলেন শখের রেডিও। যদিও রেডিও শোনার নেশা তারও আগে থেকে। ১৯৭৬ সালে, পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় পাড়ার বাসিন্দা সম্পর্কে দাদু বাসুদেব হাজরার বাড়িতে গিয়ে রেডিও শোনা শুরু। সেটাই ছিল গ্রামের একমাত্র রেডিও। সপ্তাহের প্রতি বুধবার আকাশবাণীতে চলতো কলকাতার নামিদামি যাত্রাদলের অনুষ্ঠান । গ্রামের সবাই সেই রেডিওর কাছে গিয়ে বসতো । তিনি জানান -বাবা না থাকলেও রয়ে গিয়েছে সেই রেডিওটা । তারপর থেকে রেডিওকে হাতছাড়া করেননি তিনি। তিনি বলেন, “৪৫ বছর আগে বাবার কাছ থেকে পাওয়া এই রেডিওটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা। পরে শিক্ষকতা পেলেও, রেডিওকে ছাড়ার কথা ভাবিনি। যতই টিভি থাক , রেডিওতে না শুনলে, মহালয়ার চণ্ডীপাঠ কেমন পানসে লাগে। তাই মহালয়ার আগে যাতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী ‘শুনতে অসুবিধা না হয় ,সেই জন্য কয়েকদিন আগে পুরুলিয়া থেকে রেডিও সারিয়ে এনেছি।”
তিনি বলেন, ” স্কুল, কলেজ যেখানেই পড়তে গিয়েছি, সেখানেই আমার সাথি ছিল রেডিও । রেডিও না শুনলে পড়াশোনাতে মন বসতো না । রেডিওই ছিল আমার সাফল্যের চাবিকাঠি।”
একসময় রেডিওকে সকলে নিজের আত্মীয় বলে মনে করতো। খবর শোনা ,গান বাজনা ,নাটক ,কৃষি কথা থেকে ক্রিকেট ,ফুটবল সহ নানা খেলার ধারা বিবরণী শোনা যেতো। চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রেডিও বা হাতের পাশে রেডিও -এই ছিল চেনা ছবি । তবে ভালো দাম থাকায় অনেক গেরস্থই কিনতে পারতো না। তারা প্রতিবেশীদের বাড়িতে রেডিও শুনতে যেতো। যাঁদের ক্ষমতা থাকতো তারা মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে রেডিও উপহার দিতেন। বর্তমানে হাতেগোণা কিছু প্রবীণ মানুষজন রেডিও শুনলেও, রেডিওর চাহিদা দিন দিন কমে চলেছে। বলা যায় , সময়ের দাবি মেনে রেডিও কার্যত বিলুপ্তির পথে।
প্রায়দিনই মধুসূদন বাবুর বাড়িতে রেডিও শুনতে আসেন গ্রামের বাসিন্দা মথুর দাস,ভরত মাহাত,চক্রধর মাহাতোরা। মথুর দাস বলেন, ” আগে আমাদের বাড়িতেও রেডিও ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে সেই রেডিওর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাই সময় হলেই, রেডিও শুনতে চলে আসি মধুবাবুর বাড়ি। মহালয়ার ভোরে তো কথাই নেই।”
তবে নবীন প্রজন্মের রেডিও শোনার প্রতি যে ঝোঁক কমছে ,তা স্পষ্ট মধুসূদন বাবুর ছেলের সত্যজিতের কথায়। তার কথায়, “মোবাইলে সমস্ত কিছু শোনা ও দেখা যায়। তাই রেডিও শোনার কথা ভাবিনি। তবে বাড়িতে এলে বাবার কাছে মাঝে মাঝে রেডিও শুনি।
Post Comment