সুজয় দত্ত , পুরুলিয়া:
কালহা, একটা সময়ে জীবন্ত মানুষের জন্যও নির্জন হয়ে যেত অযোধ্যা পাহাড়ের এই গ্রাম। মৃত্যুর পর মৃত্যুর ওই অজানা ঢেউ, লোকচক্ষুর আড়ালে করা বাস্তবের কথাকে জিজ্ঞাস্য করে বসেছিল—এখানে কি সত্যিই কোনো অতিলৌকিক ঘটনা ঘটেছে? পাঁচ দশক আগে তখনকার দুর্গম অযোধ্যা পাহাড়ের কালো-ছায়া নেমে এ গ্রামটাকে পরিণত করেছিল শ্মশানে। ভয়ে-আতঙ্কে একে একে মানুষ চলে গেছেন পাহাড়ের হিলটপে, অন্য গ্রামে কিংবা পাহাড়তলির সিরকাবাদে। কালের ক্রমে পরিস্থিতি সামান্য স্বাভাবিক হতে না হতে আবার এক আত্মহত্যা—আর ভয় ফিরে আসে।
গ্রামের নাম লেখা সিমেন্টের বোর্ড উবে যাওয়া, গাছে দড়ি টাঙানো ভাঙা আয়না— এসবের মধ্যেই ফিরেই এসেছিল পুরোনো ভয়ের আবহ। কিন্তু এই ভয়ে কেবলমাত্র স্থানীয় প্রবীণরাই বিশ্বাসী—যুবক-যুবতীরা বলছেন, “ভূত-পেত্নীর কাহিনি তো মনের ভুল।”
এই ভীতির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন জেলার দুটি বিজ্ঞানমনা সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, পুরুলিয়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায় জানান, “নয় বছর আগে ওই গ্রামে একটি কর্পোরেট কোম্পানির দ্বারা যখন আলু চাষ হচ্ছিল, তখনই এলাকা বেশ জমজমাট। সেসময় এক মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। আতঙ্ক ফিরে আসে। পরে আমাদের বোঝানোয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। আমরা ঘোষণা করেছি—যদি কেউ ভূত দেখাতে পারেন স, পাঁচ লক্ষ টাকা দেব।”
অন্যদিকে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পুরুলিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো বলেন, “আমাদের ঘোষণা অনুযায়ী ভূত-ডাইনি বা যে কোনো অলৌকিক কিছুর প্রমাণ দেখাতে পারলে আমরা পঞ্চাশ লাখ টাকা দেব। ভূত চতুর্দশীর দিনেও আমরা এই ইস্যুটি সামনে এনেছি। গত কয়েক বছরে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যেখানেই ভূতের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে আমাদের দল গিয়েছে — কিন্তু কোথাও কোনো ভূত পাওয়া যায়নি। এগুলো সব কুসংস্কার ও অপপ্রচারের ফল।”
বহু বছর গ্রাম জনশূন্য ছিল; কয়েক যুগ পরে আবার নতুন করে জনবসতি গড়ে উঠেছে, পর্যটক আবাসও তৈরি হয়েছে। তবু গ্রামে পা দিলেই যে একটা গা ছমছমে ভাব কাজ করে—এ অভিযোগ থাকলেও, স্থানীয় অনেক যুবক এটিকে মানতে নারাজ। বিকেলের পর সেই ভয়ের মাত্রা বাড়ে বলেও প্রবীণরা মনে করেন; তাঁরা জানাচ্ছেন, “যেখানে যে পারেন পালিয়ে গেছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা যজ্ঞ-শান্তি করে এক চিলতে ঘর করেছি।”
শুধু বাঘমুন্ডির কালহা নয়, কোটশিলার বেগুনকোদর স্টেশনে ভূতের আতঙ্কই হোক আর হুড়ার অর্জুনজোড়ায় বাইক ধরা ভূত। এই দুই বিজ্ঞানমনষ্ক সংগঠন দরকারে রাত কাটিয়ে প্রমাণ করেছেন, ভূত আসলে অন্ধকারের আতঙ্ক। আর অন্ধকারকে হারাতে আলোই লাগে। পুরুলিয়ার ভুতুড়ে আবহে আজ সেই আলোর নাম—বিজ্ঞান।
প্রশ্নটা এখনও সেই একই—যাবেন নাকি, ভূত ধরে ৫৫ লক্ষ পেতে?











Post Comment