দেবীলাল মাহাতো ও সুইটি চন্দ্র, আড়শা :
সাপের সঙ্গে এ খেলা প্রাণপণ ঝুঁকির। যেন মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ! সেই মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে বিষধর গোখরোকে চুমু খেয়ে, মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে অনায়াসে খেলা দেখালেন প্রাক্তন মাও নেতা ঘেনা কুমার। একসময় অযোধ্যার জঙ্গলে হাতে নিয়েছিলেন বন্দুক। এখন সমাজের মূল স্রোতে ফেরা রাজ্য পুলিশের স্পেশাল হোমগার্ড তিনি। কিন্তু সাকিন বদলালেও পুরনো প্রেম যা সেই ১৪ বছর বয়স থেকে শুরু। সেই ঝাঁপানে সর্প ক্রীড়া আজও অব্যাহত। মনসা পূজোর পরের দিন সোমবার বিকালে আড়শার সটরা গ্রামে ঝাঁপান পরবে সেই দৃশ্যই দেখা গেল।
সাপ নিয়ে ঘেনার কাহিনি একেবারেই অন্যরকম। ছোটবেলা ঝাঁপানে অংশ নিতেন। পরে মাওবাদী দলে যোগ দিয়ে গেরিলা জীবনে অস্ত্র হাতে লড়াইয়ের কালে সাপ খেলানোয় সাময়িক বিরতি। তারপর আত্মসমর্পণ করে পুলিশের স্পেশাল হোমগার্ডে চাকরি। আবার মনসা পুজোর মেলায় সাপের খেলা শুরু। ঘেনার নিজের কথায়, ‘‘নিজের স্ত্রীর থেকেও বেশি যত্ন করি সাপকে। ব্যাঙ ধরে খাওয়াই, স্নান করাই, বিষ্ঠা পরিষ্কার করি।’’
খেলা চলাকালীন এ দিন একবার তাঁর জিভে দংশনও করে বিষধর। ঝরে রক্ত। তার কিছুক্ষণ পরেই গুরুর দেওয়া পাতা চিবিয়ে খান ঘেনা। ‘‘ওটাতেই আমার কাজ হয়ে গেল। বিষ সব উধাও।’’—দাবি তাঁর। তবে সেই পাতা বা টোটকার নাম প্রকাশ্যে বলতে নারাজ। ‘‘গুপ্ত বিদ্যা, প্রকাশ্যে বলা যাবে না।’’
মাওবাদী জীবনে সাপের খেলা না দেখালেও সাপ কামড়ানো এক সঙ্গীকে শেকড়পাতা খাইয়ে ঝাড়ফুঁক করে বিষ নামিয়ে দিয়েছিলেন ঘেনা। জঙ্গলমহলের অন্ধকার দিনগুলোতে সাপের ছোবল থেকে প্রাণে বেঁচেছিলেন মাও কমান্ডার দুর্যোধন কুমারের স্ত্রী আকরি সহিস। দুর্যোধন- আকরিও ঘেনার মতোই সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসেছেন। ঘেনার দাবি, গুরুবিদ্যা ও মনসা মাতার কৃপায় আজও বেঁচে আছেন।
তবে প্রশ্ন উঠছে আইন নিয়ে। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনে সাপ ধরে খেলা দেখানো স্পষ্টতই অপরাধ। বাঁকুড়ার ঐতিহ্যবাহী বিষ্ণুপুর ঝাঁপান ইতিমধ্যেই আইনবিরুদ্ধ বলে বন্ধ হয়েছে। অথচ পুরুলিয়ার গ্রামে এখনও চলে ঝাঁপান। পুরুলিয়া বনবিভাগের এডিএফও সায়নী নন্দীর বক্তব্য, ‘‘এভাবে বন্যপ্রাণ নিয়ে খেলা দেখানো আইন বিরুদ্ধ। আগামী দিনে আমরা সচেতনতার প্রচার চালাব।’’
এ দিন শুধু ঘেনা নন। আড়শার সটরা গ্রামে হাজির ছিলেন আরেক স্পেশাল হোমগার্ড কালীচরণ কুমার। তিনিও সাপ নিয়ে খেলা দেখান। ঝাঁপানে হাজির ছিলেন বলরামপুরের গোহালডাঙ গ্রামের বাসিন্দা ‘সাপ সম্রাট’ যুধিষ্ঠির বৈদ্যও। ৬২ বছর বয়সেও তিনি সাপের খেলা দেখান। তিনিই ঘেনার গুরু। তাঁর দাবি, ‘‘গুরুবিদ্যা ছাড়া এ খেলা সম্ভব নয়। সাপের উগ্র বিষ আমরা বের করি, তবে বিষধর কি নির্বিষ হয়? কখনও না। সবই মনসা মায়ের কৃপা।’’
পুরুলিয়ার গ্রামে এখনও ঝাঁপান মানেই আবেগ। কিন্তু ভয়ও কম নয়। কখন যে ফণা তুলে ছোবল দেয় ভুজঙ্গ , তার নিশ্চয়তা নেই। তবু প্রাক্তন মাও নেতা থেকে বর্তমান সাপ-খেলার কারিগররা বিশ্বাস রাখেন —গুরুবিদ্যা আর মনসা মাতার আশীর্বাদে বিষধরও বশ মানবে।
Post Comment