insta logo
Loading ...
×

বিবাহ বন্ধনে ‘পণ’ নেওয়া নয়, উল্টে পাত্রীকেই ‘কনেপণ’ পাত্রপক্ষের!

বিবাহ বন্ধনে ‘পণ’ নেওয়া নয়, উল্টে পাত্রীকেই ‘কনেপণ’ পাত্রপক্ষের!

দেবীলাল মাহাত, আড়শা:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’ গল্পে নায়িকা নিরুপমাকে মরতে হয়েছিল তার বাবা পাত্রপক্ষের চাহিদামতো পণের টাকা যোগাড় করতে পারেননি বলে‌। সমাজে যত আধুনিকতার ছোঁওয়া লাগছে। ততই যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পণ দেওয়া-নেওয়া। শিক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যা বিলুপ্ত হওয়ার কথা! তা না হয়ে পণের চাহিদা বাড়ছে ক্রমেই। তবে এবার বিবাহবন্ধনে ভিন্ন ছবি দেখা গেল পুরুলিয়ার পিছিয়ে পড়া অযোধ্যা পাহাড়তলির আড়শা ব্লকে। পাত্রকে নয়। পাত্রীকে নামমাত্র ‘কনেপণ’ দিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছেন পাত্র। আগামী ৪ ঠা আষাঢ় শুভ পরিণয়।

পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল আড়শা ব্লকের আশারামডি গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত রাজকিশোর মাহাতোর একমাত্র মেয়ে বীনা মাহাতোর বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয় এই ব্লকেরই রাঙামাটি গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মাহাতোর বড় ছেলে রাজেশ মাহাতোর সাথে। পাত্র-পাত্রী পক্ষের
আলোচনার ভিত্তিতে বিয়ের
দিন ঠিক হয় ৪ ঠা আষাঢ়। আর এই বিবাহে সমাজসংস্কারের বার্তা দিয়ে পাত্রপক্ষকে নয়। পাত্রীপক্ষকে সমাজের পুরানো রীতি মেনে ‘কনেপণ’ দিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে পাত্রপক্ষ। যা প্রশংসা কুড়িয়েছে ওই এলাকার মানুষজনের।

বীনা মাহাতোর বর্তমান অভিভাবক তথা জ্যেঠু ললিতকিশোর মাহাতো জানান, “আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমার দাদা প্রয়াত ভগীরথ মাহাত পণপ্রথার বিরুদ্ধে “পণ তিলকেক দু’খানি, আঁখিক লর ঝরঝর”ও “দহজেক দায়ে সমাজ কাঁদে” নামে দুটি বই লিখেছিলেন। লেখার পর তা গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার করতেন। তার অনুপ্রেরণায় আজকে আমার ভাইয়ের মেয়ে পণ ছাড়াই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
খুব ভালো লাগছে দাদার পণ প্রথার বিরুদ্ধে যে লড়াই। তা আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে।”
পাত্রের বাবা পূর্ণচন্দ্র মাহাতো জানান, “যে ভাবে সমাজে পণ দেওয়া-নেওয়া চলছে। তাতে অনেক পরিবারের কন্যার বাবা নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। এমনকি জমি-জায়গা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। সমাজের এই
বিষয়গুলি দেখে ছেলের বিয়েতে পণ নেওয়ার কথা ভাবিনি।” পাত্রী বীনার মামা ভগবান মাহাত জানান, “আদিবাসি কুড়মি সমাজের নেগাচারি মতে পাত্রীর পরিবারের কাছ থেকে ‘পণ’ নেওয়া যায় না। ‘কনেপণ’ দিয়ে পাত্রকে বিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল। এই কু’প্রথার বিরুদ্ধে সমাজে আন্দোলন চলছে। আমার ভাগ্নির শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে এবং সমাজে পণপ্রথার অভিশাপ মুক্ত করার জন্য রাঙামাটি গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মাহাতো তার ছেলের সাথে আমার ভাগ্নির পণ ছাড়াই বিবাহের সম্বন্ধ ঠিক হয়েছে। সমাজের ব্যাধিকে দূর করার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।” আদিবাসী কুড়মি সমাজের মূল খুঁটি, মূল মানতা (প্রধান
নেতা) অজিতপ্রসাদ মাহাত জানান, “আদিবাসী কুড়মি সমাজের বিভিন্ন দাবির মধ্যে অন্যতম হলো কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই। তার একটি অঙ্গ ‘পণপ্রথা’। কিছু দিন আগেই মুরগুমাতে নেগাচারি নিয়মে পণ ছাড়াই পাত্র-পাত্রীর বিবাহ দেওয়া হয়। কু’প্রথা থেকে দিনদিন যেভাবে সমাজ বেরিয়ে আসছে এটা একটা ভালো দিক। দুটি পরিবারকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির জেলা সম্পাদক মধূসুদন মাহাত জানান, “পণপ্রথা এক সামাজিক অপরাধ। সকলেই এইভাবে এগিয়ে এলে একদিন সমাজ থেকে পণপ্রথা উঠে যাবে। দুটি পরিবার যে ভাবে গতানুগতিক পণপ্রথার বিরুদ্ধে হেঁটে গিয়ে সমাজ সংস্কারের বার্তা দিয়েছেন, তাদেরকে কুর্নিশ জানাই।”
কাশিপুর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড. ক্ষীরোদচন্দ্র মাহাত জানান, ” ‘কনেপণ” বলতে পনপ্রথা বা লেনদেন নয়। দুটি পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তা ও সহমর্মিতার প্রকাশ। সুখ-দুঃখের একে অপরের ভাগীদার হওয়া। দুই পরিবারের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করাই ছিল ‘কনেপণে’-র মুখ্য উদ্দেশ্য।”

যদিও ১৯৬১ সাল থেকে ভারতে পণ দেওয়া-নেওয়া দন্ডনীয় অপরাধ। আর্থিক জরিমানার সাথে রয়েছে নূন্যতম ৫ বছরের কারাদণ্ড। তবুও বন্ধ করা যায়নি এই সামাজিক কু’প্রথাকে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে যে ভাবে বীনার বিয়েতে পণ ছাড়া বিবাহ হচ্ছে তা মনে করিয়ে দিয়েছে ৩০বছর আগে তার প্রয়াত জেঠুর পণপ্রথার বিরুদ্ধে বইয়ের পাতায় লেখা এক একটি অক্ষরকে!

Post Comment