
সুজয় দত্ত
ই-মেইল: duttasujoy0@gmail.com
যোগাযোগ:৯৭৩২০৭৫৫০১
ভবঘুরে এক প্রেমিক বাঘ। এক অন্তঃসত্ত্বা প্রেমিকা। আর তাদের ছায়াপথ ধরে জেগে ওঠা প্রাচীন করিডর। পূর্ব ভারতের জঙ্গলে এই মুহূর্তে যা ঘটছে, তা কেবল বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের সাফল্য নয়, বরং জীবনের, সম্পর্কের, এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ফিরে আসার গল্প। আজ ২৯ জুলাই, আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস—এই বিশেষ দিনে তাই ফিরে দেখা যাক বাঘেদের এই নিঃশব্দ ভালোবাসা আর গর্জনের উপাখ্যান।
২০১০ সালের ২৯ জুলাই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্বের ১৩টি বাঘ-বাসযোগ্য দেশ একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়—বাঘের ক্রমহ্রাসমান সংখ্যা রুখতে চাই শক্তিশালী উদ্যোগ। সেই থেকেই প্রতিবছর এই দিনটি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস রূপে। বিশ্বের সবচেয়ে মহিমাময় শিকারি প্রজাতিটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি, বন সংরক্ষণ, শিকার রোধ, এবং করিডর পুনর্গঠনের লক্ষ্যে এই দিনটি আজ আর কেবল একটি ‘পর্যবেক্ষণ’ নয়, হয়ে উঠেছে একটি আন্দোলনের দিন। এই বিশেষ দিনের পোস্টার কাহিনি হয়ে উঠতে পারে এই প্রেমের গল্প। আর এই গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে পুরুলিয়া।
২৬ জুন ২০২৫। ঝাড়খণ্ডের পালামৌ টাইগার রিজার্ভে বৃষ্টিভেজা ভোর। খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া হয় ছত্তিশগড়-উৎপত্তি এক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের। নাম ‘কিলা’।
গত ছ’মাসে সে ঘুরেছে বাংলার বান্দোয়ান-বেলপাহাড়ি, ঝালদা-যমুনাগোড়া, দক্ষিণ বাঁকুড়া ও দলমা হয়ে আবার ঝাড়খণ্ডে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে পালামৌ দুর্গের কাছে প্রথম দেখা গিয়েছিল এই পুরুষ বাঘটিকে। ডোরাকাটা গায়ে চিহ্ন দেখে চিহ্নিত করা হয় তার ছত্তিশগড়-উৎপত্তি। তারপর ছুটে বেড়িয়েছে রাঁচি, হাজারিবাগ, ঝালদা, বান্দোয়ান, দক্ষিণ বাঁকুড়া, দলমা, বেলপাহাড়ি, যমুনাগোড়া—গোটা জঙ্গলমহল। কখনও গৃহস্থের ঘরে ঢুকে পড়ে কারও ক্ষতি না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে, কখনও বনকর্মীদের চোখের সামনে দিয়েই নির্ভয়ে হেঁটে গেছে। মানুষের মুখোমুখি হয়েছে বারবার, তবু একবারও আক্রমণ করেনি। বনের চরিত্র বিশ্লেষণে তার চেয়ে বড়ো ‘কেস স্টাডি’ আর নেই।
বন দফতর তাই তাকে ‘সফট রিলিজ’ করেছে। ট্র্যাপ ক্যামেরা নজর রাখছে তার শিকার ও চলাফেরায়। সে যে শিকার করতে সক্ষম সেই প্রমাণ দিতে পারলেই মিলবে স্থায়ী মুক্তি। ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরাও পড়েছে তার শিকারের ছবি।
এদিকে কিলার প্রেমিকা ‘জিনাত’কে ২০২৪ সালের নভেম্বরে মহারাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছিল ওড়িশার সিমলিপালে। সিমলিপালের বাঘেদের জিনগত পরিবর্তন নব্য প্রজন্মকে করে তুলছিল হলুদ কালো ডোরাকাটার বদলে কালচে বর্ণের। জিনাত ও যমুনাকে তাডোবা থেকে সিমলিমালে আনার উদ্দেশ্যই ছিল মেলানিস্টিক (কালো) পুরুষ বাঘের সঙ্গে সঙ্গম ঘটিয়ে ঐতিহ্যবাহী হলুদ ডোরাকাটা জিনগত বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনা। সাফল্য মিলেছে। আজ জিনাত অন্তঃসত্ত্বা। আগস্টের শেষ কিংবা সেপ্টেম্বরের শুরুতেই জন্ম নিতে চলেছে সেই স্বপ্নের শাবক।
এই ঘটনা শুধু ব্যাঘ্র প্রজননের গল্প নয়, এ হলো এক বিপন্ন প্রজাতিকে ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া। এটি সেই আশার প্রতীক, যা আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবসের পোস্টার হতে পারে।
জিনাত ও কিলার ভ্রমণপথ ধরে খুঁজে পাওয়া গেছে পূর্ব ভারতের দুটি ব্যাঘ্র করিডর।
▪️প্রথমটি—ঝাড়খণ্ডের দলমা থেকে চান্ডিল, তারপর বান্দোয়ান-বেলপাহাড়ি হয়ে ফের দলমা পর্যন্ত (প্রায় ২৫০ কিমি)।
▪️দ্বিতীয়টি—পালামৌ-হাজারিবাগ-রাঁচি থেকে ঝালদা, অযোধ্যা, কোটশিলা পর্যন্ত বিস্তৃত (প্রায় ৩০০ কিমি)।
এই করিডর রক্ষায় যৌথভাবে কাজ করছে বাংলা ও ঝাড়খণ্ড বনবিভাগ। বসানো হয়েছে ২০টিরও বেশি ট্র্যাপ ক্যামেরা। বাড়ানো হয়েছে চিতল, কাঁকর, শূকর প্রজাতির সংখ্যা। লাগানো হচ্ছে ঔষধি গাছ। এবং স্থানান্তরিত করা হচ্ছে করিডরের ভিতরের গ্রামগুলি—পালামৌর অন্তত ৩৫টি গ্রাম এই পরিকল্পনায় রয়েছে, যার মধ্যে দুটি ইতিমধ্যেই সরে গেছে।পালামৌর ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর প্রজেশকান্ত জেনা বলেন, “এই ভবঘুরে বাঘ দুটির কারণেই তিন দশক আগের প্রায় ৭০০ কিমি দীর্ঘ একটি প্রাচীন ব্যাঘ্র করিডর আবার চিহ্নিত হয়েছে। আমরা চাই এই রাস্তাগুলি স্থায়ীভাবে কার্যকর হোক।”
আজ ২৯ জুলাই যখন সারা বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবস পালন করছে, তখন কিলার সফট রিলিজ, জিনাতের গর্ভধারণ এবং পূর্ব ভারতের করিডর চিহ্নিতকরণ যেন এই দিনের তাৎপর্যকে জীবন্ত করে তোলে। কেবল ছবি তোলার পোজ নয়, বাঘ আজ এক পরীক্ষিত চরিত্র—যার অস্তিত্ব প্রমাণ করে, যদি মানুষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে দিতে পারে, তবে বাঘ নিজেই নিজের ঠিকানা খুঁজে নেয়।জঙ্গলের নিঃশব্দ চলাফেরায় জেগে উঠেছে নতুন সম্ভাবনার ধ্বনি। কিলা ও জিনাত—এই দুই বাঘের পদচিহ্ন ধরে প্রকৃতি কি সত্যিই ফিরিয়ে দেবে আমাদের সেই হারানো ব্যাঘ্র অভয়ারণ্য?
জিনাতের যাতায়াত
◾১৫ নভেম্বর, ২০২৪
মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে তিন বছরের জ়িনতকে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে আনা হয়েছিল। কয়েক দিন পরে রেডিয়ো কলার পরানো হয়।
◾ ২৪ নভেম্বর,২০২৪
জিনাতকে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে ছাড়া হয়েছিল।
◾২৮ নভেম্বর, ২০২৪
ঝাড়খণ্ডের দিকে হাঁটতে থাকে সে। কয়েক দিন ঝাড়খণ্ড ঘুরে চাকুলিয়া রেঞ্জের রাজাবাসার জঙ্গল পেরিয়ে ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি থানার অন্তর্গত কাটুচুয়া জঙ্গলে ঢুকে পড়ে।
◾২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঝাড়গ্রাম থেকে বাঘিনি ঢুকে পড়ে পুরুলিয়ারা বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়ের জঙ্গলে।
◾২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
জিনাতের অবস্থান পুরুলিয়া জেলার মানবাজার ২ নং ব্লকের ডাঙরডি মোড়ের পাশে ধরমপুরের পাইসাগড়া জঙ্গলে।
◾২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
মানবাজার ১ নং ব্লকের ধানাড়া হয়ে বাঁকুড়ার রানিবাঁধের গোপালপুর জঙ্গলে জিনাত৷ তাকে নেট দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। করা হয় ঘুম পাড়ানি গুলি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
◾২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪
অবশেষে ৬ নং ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু সিমলিপালের বাঘিনী জিনাত ওরফে গঙ্গা। রবিবার বিকালে বাঁকুড়ার রানিবাঁধের গোঁসাইডি এলাকায় তাকে ঘুমপাড়ানি গুলি ছোঁড়া হয়। গায়ে লেগেছে গুলি। ঘুমিয়ে পড়েছে বাঘিনী। তাকে এদিনই ওখান থেকে নিয়ে চলে যাওয়া হচ্ছে নিজের বাড়ি।
◾৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪
আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে সিমলিপাল অভয়ারণ্যে ফিরল জিনাত।
কিলা কারনামা
◾৩১ শে ডিসেম্বর ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা- খরসোঁওয়া বনবিভাগের চান্ডিল বনাঞ্চলের বালিডিতে একটি গবাদি পশু ও বাছুর মেরে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল।
◾চান্ডিল বনাঞ্চল থেকে খুঁটি বনাঞ্চলের তামাড় এলাকাও ঘুরে আসে সে।
◾এরপর আশ্রয় দলমা পাহাড়ে। মাঝেমধ্যে লোকালয়ে তাকে দেখতে পাওয়ার দাবি উঠেছেম
◾১২ই জানুয়ারি দলমা থেকে প্রবেশ করে বাংলায়।
◾১৭ জানুয়ারি শুক্রবার বান্দোয়ানের জানিঝোড় গ্রামের বাসিন্দা যুধিষ্ঠির মাহাতো সন্ধ্যায় বান্দোয়ানের তালপাত থেকে নিজের বাড়ি জানিঝোড় যাওয়ার পথে নেকড়া গ্রামের কাছে বাঘের দেখা পেয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন একেবারে মুখোমুখি হয়েও বাঘ স্রেফ মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছিল
◾১৮ জানুয়ারি শনিবার বান্দোয়ানের ভাঁড়ারির জঙ্গলে ভোর ৩ টে ২৪ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে প্রথমবার ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা পড়েছে তার ছবি।
◾২০ জানুয়ারি। ৪৮ ঘন্টার লাগাতার বাঘবন্দি অভিযানে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে ফের ঝাড়খন্ডে চলে যায় সে।
◾ ২৩ জানুয়ারি ফের বাংলায়। বেলপাহাড়িতে ট্র্যাপ ক্যামেরায় ছবি তুলিয়ে দক্ষিণ বাঁকুড়ায় চলে যায় সে।
◾২৬ জানুয়ারি আবার বান্দোয়ানে চলে আসে বাঘটি। উপস্থিত বুদ্ধির বলে গায়ের চাদর মাথার ওপর বনবন ঘুরিয়ে বাঘের মুখোমুখি হয়েও বাঁচলেন পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের পুকুরকাটা গ্রামের কৃষক যুবক সর্বেশ্বর মান্ডি।
বান্দোয়ান থেকে আবার দক্ষিণ বাঁকুড়া যায় বাঘটি। সেখান থেকে ফের পুরুলিয়ার যমুনাগোড়া।
◾২৮ জানুয়ারি আবার দলমায় বাঘ।
◾১ মার্চ শেষবার দলমার ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা পড়ে সে।
◾২৫ জুন ঝাড়খণ্ডের সিল্লি থানার মারদু গ্রামে গৃহস্থের বাড়ি থেকে বাঘবন্দি।
◾২৬ জুন পালামৌ জঙ্গলে সফট রিলিজ।
duttasujoy0@gmail.com
9732075501





Post Comment