দেবীলাল মাহাত, পুরুলিয়া:
এ হলো প্রাণের বান্ধব খুঁজে নেওয়ার দিন। ফুল পাতানোর ঐতিহ্য নিয়ে সাবেক মানভূমের এই ভূখণ্ডে আসে
ভাদ্র সংক্রান্তি। এই দিন শুধু পঞ্চকোট রাজবংশের কাছে নয় স্থানীয় আদিবাসী থেকে শুরু করে কৃষকদের কাছেও দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সাবেক মানভূমে দিনটি ছাতা পরব হিসাবে পালিত হয়। এদিনই অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকর্মা পুজো। পঞ্চকোট রাজের বিজয় উৎসব হিসেবে দিনটি চিহ্নিত হয়েছিল। তাই রাজতন্ত্র বিদায় নিলেও আজও ভাদ্র সংক্রান্তির দিন একদিনের রাজা হয়ে বসেন পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরসূরি অমিত লাল সিংদেও। পরনে রাজবেশ, হাতে তরবারি,কোমরে কৃপাণ ধারণ করে হুডখোলা গাড়িতে চেপে রাজা অমিত উপস্থিত হন চাকোলতোড় মাঠে । তারপর প্রথা মেনে রাজবেশে তোলেন ছাতা। ছাতাট্যাঁড়ে সেই রাজাকে দেখতে ভিড় জমান কয়েক হাজার মানুষ।
কয়েকশো বছর ধরে বংশপরম্পরায় ভাদ্র সংক্রান্তির দিন প্রথা মেনে হয়ে আসছে চাকলতোড়ে ছাতা পরব।
বাংলার বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ঝাড়খন্ড, বিহার, ওড়িশা , ছত্তিশগড় থেকে মানুষজন আসেন। সকলের উপস্থিতিতে মেলা হয়ে ওঠে মিলনমেলা। এই পরবের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। তবে উৎসবের সূচনায় জড়িয়ে রয়েছে পঞ্চকোট রাজবংশের নাম। জানা যায় পঞ্চকোট রাজবংশের কোনো এক রাজা যুদ্ধে বের হয়েছিলেন। কিন্তু অনেক দিন কেটে গেলেও রাজার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না । রাজপরিবারে বাড়ছিল দুঃশ্চিন্তা । এমন সময় খবর আসে রাজা যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসছেন। সেই সময় দ্রুত প্রজাদের কাছে বিজয় সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য জয়ের প্রতীক হিসেবে ভাদ্র সংক্রান্তির দিন ছাতা তুলে বিজয় বার্তা ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকেই আজও সাবেক মানভূমে বিজয় দিবস দিনটি ছাতা পরব হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
কৃষকদের কাছেও দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকরা এদিন সকালে ধানের ক্ষেতের মাঝে ডালি (সিঁন্দুয়ার,শাল ডাল) পোঁতেন। তাদের বিশ্বাস,এই ডালির পাতা শুকিয়ে মাটিতে মিশে গেলে ধানের ফলন ভালো হয়। রোগ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া ওই শুকনো ডালে রাতে পেঁচা বসলে ইঁদুরের উপদ্রব হয় না। কাশিপুর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাত জানান – ডালি পোঁতার মধ্য দিয়েই কৃষকরা এদিন ধানের ক্ষেত জমি পরিদর্শন করেন।
সাঁওতাল সমাজের মানুষের কাছে ছাতাট্যাঁড় হল মহামিলনের জায়গা। ছাতা পরবে সামিল হওয়া মেয়েদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের। সারা রাত ধরে চলে নাচগান। বসে হাঁড়িয়ার আসর। সাঁওতাল ছেলে মেয়েরা ছাতাট্যাঁড়েই খুঁজে নেয় আপন আপন জীবন সঙ্গী,সঙ্গিনী। চেহারায় দুজনের মিল থাকলে ‘ফুল’পাতিয়ে নেন।
Post Comment