insta logo
Loading ...
×

ধনতেরাসে ঝাঁটা কেনে কেন? কেনই বা সোনা রুপোর গয়না?

ধনতেরাসে ঝাঁটা কেনে কেন? কেনই বা সোনা রুপোর গয়না?

সুজয় দত্ত

গত বিশ বছর আগেও বাঙালি সংস্কৃতিতে ধনতেরাসের ছোঁয়া লাগেনি। দীপাবলি মানেই ছিল আলোর উৎসব, কালীপুজো, আর সেই সঙ্গে আতসবাজি-রঙিন আলো। কিন্তু মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাবে, টেলিভিশন-বিজ্ঞাপনের যুগে, আর উত্তর ভারতের প্রভাবের স্রোতে আজ ধনতেরাস ঢুকে পড়েছে বাঙালির ঘরে ঘরে। সোনার দোকানে ভিড়, রুপোর হাঁড়ি-বাটি কেনার ধুম—সব মিলিয়ে নতুন এক উৎসবের রং মেখেছে কার্তিকের আকাশে।

কিন্তু ধনতেরাস কাকে বলে? কেনই বা পালন করা হয়?

দীপাবলি উৎসব মূলত পাঁচ দিনের। প্রথম দিনটি পড়ে গৌণ চান্দ্র কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে। এই দিনটি ধন ত্রয়োদশী বা ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী নামে পরিচিত, স্থানভেদে আবার একেই বলা হয় ধনতেরাস। এই দিনে ধন বৃদ্ধির জন্য অনেকে সোনা, রূপা কিংবা নতুন ধাতব সামগ্রী কেনেন। অন্যদিকে অপমৃত্যু নিবারণের জন্য গৃহের বহির্ভাগে দীপদান করারও প্রথা আছে।

পুরাণে বলা হয়েছে, যে তিথিতে সমুদ্র মন্থন থেকে অমৃতকলস হাতে ধন্বন্তরী আবির্ভূত হন, সেটিই ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী। সমুদ্র মন্থনের ফলে উৎপত্তি হয়েছিল চৌদ্দ রত্নের—লক্ষ্মী, কামধেনু, ঐরাবত, কৌস্তুভ মণি, কল্পবৃক্ষ, চন্দ্র, পারিজাত, শঙ্খ, বারুণী, অপ্সরা, ধন্বন্তরী, অমৃত, হলাহল এবং শঙ্খনিধি-পদ্মনিধি। এই দিনেই দেবী লক্ষ্মী, ভগবান গণেশ এবং ধনদেব কুবেরের পূজা করা হয়।

ধন্বন্তরীকে বিষ্ণু নিযুক্ত করেন বৈদ্য, বনস্পতি ও ওষুধের অধিপতি হিসেবে। তাঁর আশীর্বাদে সমস্ত রোগের বিনাশ ঘটে বলেই বিশ্বাস। সমুদ্র মন্থনের সময় শরৎ পূর্ণিমায় জন্ম নেন চন্দ্র, দ্বাদশীতে কামধেনু, ত্রয়োদশীতে ধন্বন্তরী এবং অমাবস্যায় আবির্ভূত হন মহালক্ষ্মী। মানুষের কল্যাণের জন্য ধন্বন্তরীই প্রথম ‘অমৃতময় ওষুধ’-এর সন্ধান দেন।

ধন্বন্তরীর বংশেই জন্ম নেন চিকিৎসার জনক দিবোদাস, যিনি মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র সুশ্রুতের গুরু ছিলেন। সেই সুশ্রুতই রচনা করেন ‘সুশ্রুত সংহিতা’—আয়ুর্বেদের এক মহাগ্রন্থ।
এই ধন্বন্তরীর স্মৃতিতেই ভারত সরকার ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ধনতেরাসকে “জাতীয় আয়ুর্বেদ দিবস” হিসেবে পালন করছে।

পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, ধনতেরাসের দিন নিষ্ঠাভরে পুজো করলে অকালমৃত্যুর আশঙ্কা দূর হয়। এদিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক চিরচেনা কাহিনিও।

এক রাজা হিমার পুত্রের ওপর ছিল অভিশাপ—বিয়ের চতুর্থ দিনেই তাঁর মৃত্যু হবে। রাজা বিয়েতে রাজি ছিলেন না, কিন্তু এক রাজকন্যার সঙ্গে প্রেমে পড়ে রাজপুত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নববধূ অভিশাপের কথা জেনে মনস্থির করেন স্বামীকে রক্ষা করবেন। বিবাহের চতুর্থ দিনে তিনি গণেশ ও লক্ষ্মীর পূজা করে তাঁদের সন্তুষ্ট করেন। দেবদ্বয় পরামর্শ দেন—যদি যমরাজকে গৃহে প্রবেশ করতে না দেওয়া যায়, রাজপুত্রের প্রাণ রক্ষা পাবে।

তখন নববধূ রাজপ্রাসাদের যে ঘরে স্বামী ঘুমোচ্ছেন, তার চারপাশে সোনা-রুপোর অলঙ্কার ছড়িয়ে রাখেন, জ্বালিয়ে দেন শত প্রদীপ। সর্পবেশে যমরাজ সেই আলো আর অলঙ্কারের ঝলকে দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। রাজপুত্রের কক্ষে পৌঁছাতে না পেরে ভোর পর্যন্ত ঘুরে অবশেষে যমলোকে ফিরে যান। সেই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী—যা পরবর্তীকালে ধনতেরাস নামে পূজিত হয়।

আরও এক বিশ্বাস বলে, লক্ষ্মীদেবী একদা মুনি দুর্বাসার অভিশাপে স্বর্গ ত্যাগ করে সাগরে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে সমুদ্র মন্থনের সময়ই তিনি ফিরে আসেন ক্ষীরসাগর থেকে। সেই অন্ধকার অমাবস্যায় স্বর্গলোক আলোয় সজ্জিত করে লক্ষ্মীকে বরণ করা হয়েছিল। মা কালী তখন অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটান, আর মা লক্ষ্মী আনেন শ্রীবৃদ্ধি—দু’জনের মিলনেই দীপাবলি পূর্ণতা পায়।

ধনতেরাসের দিন নতুন ঝাড়ু আনার বিশেষ প্রথা আছে। তবে প্রথমেই পুরনো ঝাড়ুর পূজা করে তবেই নতুন ঝাড়ুকে সিঁদুর ও আতপ চাল নিবেদন করে ব্যবহার শুরু করতে হয়।

সন্ধ্যায় উত্তর দিকে কুবের ও ধন্বন্তরীকে প্রতিষ্ঠা করে একমুখী ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয়। কুবেরকে সাদা মিষ্টি এবং ধন্বন্তরীকে হলুদ মিষ্টি নিবেদন করা হয়। প্রথমে “ওম হ্রীম কুবেরায় নমঃ” জপ, পরে ধন্বন্তরী স্তোত্র পাঠ—এর পরেই প্রসাদ গ্রহণ করা হয়। দীপাবলির দিনে কুবেরকে সম্পদের স্থানে এবং ধন্বন্তরীকে পূজাস্থানে প্রতিষ্ঠা করার প্রথা আছে।

ধন, দীপ আর জীবনের মঙ্গলকামনায় ভাসে এই দিন। সোনা বা রুপো কেনার বাইরে ধনতেরাসের আসল তাৎপর্য লুকিয়ে আছে অমৃতের সন্ধান, রোগমুক্তি আর জীবনের আলোর মধ্যে।

Post Comment