insta logo
Loading ...
×

জগজ্জননীকে প্রাণ দেওয়া শিল্পীর জীবন মহাজনের সুদের খাতায় বন্দি

জগজ্জননীকে প্রাণ দেওয়া শিল্পীর জীবন মহাজনের সুদের খাতায় বন্দি

নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া:

প্রতিমার শরীরে মাটি চাপানো হয়েছে সূক্ষ্ম যত্নে। বাঁশ, খড়, মাটি, রঙ, শোলার সাজ—সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে দুর্গা মূর্তি। মা আসেন, সঙ্গে পাড়ায় আসে আলো, বেজে ওঠে গান, জমে ভিড়। কিন্তু প্রতিমাশিল্পীর ঘর আলোহীন। আনন্দ নয়, ঘিরে থাকে চিন্তা। কারণ একেকটি প্রতিমা দাঁড়া করানোর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে মহাজনের সুদের পাহাড়। আর সেই বেড়াজালেই বন্দি তিন প্রজন্ম ধরে মৃৎশিল্পী পাল পরিবার।

শহর পুরুলিয়ার রথতলায় ফকির পাল। বয়স ৬৭। সারাজীবন মায়ের প্রতিমা গড়েছেন। তাঁর ছেলে রাজীব পাল, নাতি শুভদীপ—তিন প্রজন্ম মিলে এক ছাউনির নিচে মা দুর্গার মূর্ত রূপ ফুটিয়ে তুলছেন। জীবনের অন্ধকারে একসাথে মুখ তুলে তাঁদের অস্ফুটে প্রশ্ন, “মহাজনের সুদের ফাঁস থেকে আমরা কবে মুক্তি পাবো, মা?”

প্রতি বছর প্রতিমা গড়তে কাঠ, খড়, মাটি, সাজসজ্জা কিনতেই ৬৫-৭০ হাজার টাকা লাগে। সঙ্গে শ্রমিক মজুরি মিলিয়ে দাঁড়ায় লাখ টাকারও বেশি। এত টাকা হাতে নেই। তাই মহাজনের কাছে ধার করতে হয়। সুদের বোঝা চেপে বসে। প্রতিমা বিক্রির পর কিছুটা টাকা হাতে এলেও তার বড় অংশ চলে যায় ঋণ শোধে। শেষে হাতে থাকে সামান্য লাভ।

প্রবীণ প্রতিমা ফকির পাল বললেন, “মা দুর্গা আসেন। কিন্তু ঋণমুক্তির আশীর্বাদ দেন না। প্রতিবারই মহাজনের খাতা আরও ভারি হয়।” তাঁর ছেলে রাজীব যোগ করলেন, “বরাত মিললেও অনেকগুলোই ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণ পুঁজি নেই। এবছর যা বর্ষা! প্রতিমা শুকোতোও না। কাজও আটকে যেত।”

এমন নয় যে এ কাহিনি শুধু এই পরিবারের। রথতলা, মণিহারা, কাশিপুর পুরুলিয়ার প্রতিমাশিল্পীদের বেশিরভাগ পরিবারই একই দুঃস্বপ্নে ভোগে। প্রতিমা গড়ার মরশুমে ঋণ নিয়ে শুরু, পুজোর পর ক’টা নতুন জামা কিনতেই খরচ হয়ে যায় টাকা, আর বাকিটা চলে মহাজনের সুদে। তারপর আবার বছর ঘুরে নতুন ধার।

অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শুভদীপ প্রতিমার আঙুল গড়তে গড়তে বলল, “আমি দাদুর কাছ থেকে শিখছি। খুব ভালো লাগে। কিন্তু দাদুর কষ্ট দেখে ভয়ও হয়। ভবিষ্যতে হয়তো অন্য কিছু করতে হবে।” তার কণ্ঠেই ধরা পড়ে দ্বন্দ্ব—ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বপ্ন, আর জীবনের নির্মম বাস্তব।

পুজোর শহরে দেখা যায় প্রতিমার সামনে ভিড়। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ আলোর ঝলকানিতে মুগ্ধ। সেই মায়ের রূপের আড়ালে থাকে অগোচর শিল্পীর দীর্ঘশ্বাস। যেন মায়ের চোখ খোলা হয় না প্রতিমাশিল্পীর দিকে।

শিল্পী রাজীব পাল শেষমেশ আক্ষেপ ঝরিয়ে বললেন, “মহাজনের খাতায় আমরা বন্দি। আমাদের জীবনটা যেন শুধু সুদ মেটানো আর প্রতিমা গড়ার চক্রে আটকে গেছে।”

পুজোর সময়ে শহর ঝলমল করলেও, প্রতিমাশিল্পীর ঘরে আলো নেই। মা দুর্গা তাঁদের হাতে প্রাণ পান ঠিকই, কিন্তু সুদিন কবে আসবে—তার অপেক্ষায় দিন গোনেন রথতলার শিল্পীরা।

Post Comment