insta logo
Loading ...
×

‘গাছ দাদু’র মাথায় ছাদ, অর্ধ সত্যে ফের বিতর্ক

‘গাছ দাদু’র মাথায় ছাদ, অর্ধ সত্যে ফের বিতর্ক

সুইটি চন্দ্র , বাঘমুণ্ডি:

ফের অর্ধসত্য, ফের সেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল ভিডিও, ফের বিতর্ক। জিলিংসেরেং-এর মালতী মুর্মুর বিনে পয়সার স্কুলের পর এবার পদ্মশ্রী ‘গাছদাদু’ দুখু মাঝি।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। কাদায় মাখামাখি উঠোন। এক কোণে বাঁশে ঠেকানো দেওয়াল যেন কোনও ভাবে ধসে পড়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে। মাথার উপর ছাদ নয়, কেবল একটা কালো ত্রিপল। ঘরের ভিতরেও জল পড়ে। ভেতরের একটা পাত্রে সেই জল ধরে রাখা হয়।ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দেওয়াল ধসে পড়া আটকাতে বাঁশ গোঁজা হয়েছে। ঘরের ভিতরেও বড় খুঁটি দিয়ে কোনও মতে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে চাল-দেওয়াল। বাইরের থেকে যতটা ভগ্নপ্রায় মনে হয়, ভিতরের অবস্থাও ততটাই করুণ। এই বর্ষায় এ ভাবেই দিন গুজরান হচ্ছে দুখু মাঝির — যাঁকে দেশ চেনে ‘গাছ দাদু’ নামে, যাঁকে ভারত সরকার এক বছর আগে ভূষিত করেছে পদ্মশ্রী সম্মানে। এই ছবি ভাইরাল হওয়ার পর ফের প্রশ্ন উঠেছে — কেন এক জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির মাথার উপর এখনো নেই পাকা ছাদ? পদ্মশ্রীর এক বছরের বেশি কেটে গেলেও এখনও তাঁকে বাস করতে হচ্ছে এমন একটি কাঁচা ঘরে, বর্ষার এই ভয়ানক সময়ে যখন তার ছাউনির ওপরে টালি-খাপরা ভেঙে গিয়েছে। শুধুই একটি ত্রিপলের উপরেই ভরসা ‘গাছ দাদু’-র। গাছ লাগিয়ে পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী। অথচ মাথার উপর নেই ছাদ? ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োতে এমনই ছবি ধরা পড়ার পর ফের একবার উত্তাল সোশ্যাল মিডিয়া। চোখে জল, মাথায় ত্রিপল — ‘গাছ দাদু’ দুখু মাঝির করুণ অবস্থার ছবি নাড়িয়ে দেয় বহু মানুষকে।

দুখু মাঝি আর তাঁর স্ত্রী চুমকি মাঝি বলছেন, ” কোথাও গেলে পদ্মশ্রী সম্মান ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়। ঘর পড়ে গেলে সেই স্মৃতিও তো চলে যাবে ওটুকুই তো সম্বল।”

কিন্তু প্রশাসনের দাবি, এই ছবি সম্পূর্ণ নয়। কারণ সরকারি নথিতে দেখা যাচ্ছে, আবাস যোজনায় ইতিমধ্যেই একটি পাকা বাড়ি রয়েছে দুখু মাঝির নামে।
ঠিক তখনই ঘটনায় নয়া মোড়। শনিবার বাঘমুণ্ডির সিঁদরি গ্রামে দুখুর খোঁজে হাজির রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রতিনিধি গৌতম রায় ও বিজেপির স্থানীয় কর্মীরা। ভিডিয়ো কলেই কথা বলেন শুভেন্দু। জানান, গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষার কাজে অবদানের জন্য পদ্মশ্রী পাওয়া এই মানুষটি যেন খোলা আকাশের নীচে না থাকেন — সে জন্য প্রাথমিক আর্থিক সাহায্য তাঁকে দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে পুরো পাকা বাড়ি বানানোর খরচ বহনেরও আশ্বাস দিয়েছেন শুভেন্দুবাবু।

শেষমেশ স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি থানার সিন্দ্রী গ্রামের ‘গাছ দাদু’ বলে পরিচিত পদ্মশ্রী সম্মানপ্রাপ্ত পরিবেশপ্রেমী দুখু মাঝির। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটা পাকা ছাদের তলায় মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেই স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। দুঃখুবাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে ২ লক্ষ টাকা। আর সেই টাকাতেই সোমবার পাকা বাড়ির জন্য ভূমিপুজো সেরে ফেললেন বছর আশির বৃদ্ধ।

অর্ধভগ্ন কাঁচা বাড়ি, তার উপরে ছাউনি বলতে ত্রিপল। সেখানেই এতদিন বাস ছিল দুঃখুবাবুর। সংসারে বৃদ্ধা স্ত্রী, এক বিকলাঙ্গ পুত্র। যদিও আবাস যোজনায় একখানি বাড়ি পেয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেই থাকেন বড় ছেলে, পুত্রবধূ এবং চার নাতি-নাতনি। ফলে বাধ্য হয়েই নিজের পুরনো কাঁচা ঘরেই দিন কাটাতে হত দুঃখু মাঝিকে।

তবে জীবনের প্রতিকূলতায় নুইয়ে পড়েননি তিনি। বরং অক্লান্তভাবে গাছ লাগিয়ে গেছেন মাঠে, ঘাটে, শ্মশানে। গাছ তাঁর কাছে শুধুই শখ নয়, এক গভীর দায়িত্ব। জীবনের শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলেন—অক্সিজেন মানেই গাছ। তাই ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে আজও সেই চর্চা থামেনি। নিজে হাতেই রোপণ করেছেন কয়েক হাজার গাছ।

বিজেপি নেতা গৌতম রায় বলেন, “বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কথা দিয়ে কথা রাখেন। সেদিন আমি পদ্মশ্রী দুখু মাঝির বাড়িতে ওঁর প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিলাম। গাছ দাদুর সঙ্গে ভিডিও কলে তাঁর কথা বলিয়ে দিয়েছিলাম। তখনই দুঃখু মাঝিকে পাকা বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শুভেন্দু বাবু। তারই প্রথম ধাপের ২ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছেন তিনি।”

ব্যাঙ্কে টাকা আসতেই দুঃখুবাবু আর দেরি করেননি। পাকা বাড়ির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ভূমিপুজো সেরে ফেলেছেন তিনি। আর তার সঙ্গেই নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঘোষণা করেছেন, “আমি শুভেন্দুবাবুর নামে ১০০টি গাছ লাগাব।”

অন্যদিকে পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি নিবেদিতা মাহাতো বলেন, ” পরিবেশ প্রেমী পদ্মশ্রী দুখু মাঝি পুরুলিয়ার গর্ব। তবে ভাইরাল হওয়া বিষয়টি আদৌ সত্য নয়। খতিয়ে দেখা হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনায় দুখু মাঝির নামেই একটি পাকা বাড়ি রেকর্ডে রয়েছে। সরকারি আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি তাঁকে দেওয়া হয়েছে। “

দুখু মাঝিও স্বীকার করেছেন বাড়ি পেয়েছেন তিনি। পান বার্ধক্য ভাতা। ভাতা পায় বিশেষ ভাবে সক্ষম সন্তান। তাঁর নামে পাওয়া আবাস যোজনার বাড়িতে থাকে বড়ো ছেলে, বউমা আর চার নাতি নাতনি।

প্রশ্ন উঠছে তবে কি আবেগ দিয়ে রাজনীতির মঞ্চ তৈরি হচ্ছে? সামাজিক মাধ্যমের ভাইরাল কনটেন্ট কি শুধুই সত্য নয়, অর্ধসত্য হয়ে উঠছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখা যায়, তার পিছনে সম্পূর্ণ সত্য সব সময় থাকে না। আবেগপ্রবণ করে তোলা ভিডিও অনেক সময় বাস্তবের একমাত্র চিত্র নয়।

Post Comment