নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া:
সুইসা ট্রিপল মার্ডারের রহস্য উন্মোচনে বৃহস্পতিবার সকালটা যেন হয়ে উঠল।সিনেমার দৃশ্য। জিআরপি-র ঘেরাটোপে ধৃত দুই খুনি— বাবুজান মোমিন ও বিজয় মাছুয়ার— ফিরল সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে। ফরেনসিক দল, স্থানীয় পুলিশ, জিআরপি— সকলে মিলে তাদেরকে দিয়ে করালো ঘটনার প্রতিটি মুহূর্তের পুনর্নির্মাণ। নিহত কাজল, তার বোন রাধা ও সাত বছরের মেয়ে রাখির শেষ মুহূর্তগুলো যেন নতুন করে সামনে এলো।
তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। নিহত কাজলের স্বামী অজয় মাছুয়ারের সঙ্গে ধৃত বাবুজান মোমিনের পরিচয় বহু দিনের। বাবুজানের সঙ্গে কাজলের পরকীয়া চলছিল। আবার কাজলের বোন রাধার প্রেমিক ছিলেন বাবুজানের ইটভাটার শ্রমিক বিজয়। বাবুজানের ভাটায় কাজ করত এই তিনজন— কাজল, রাধা ও বিজয়। অজয়ের সঙ্গে বাবুজানের বন্ধুত্বও ছিল।
ঘটনার কয়েক দিন আগে অজয় গিয়েছিল গোয়া। সংসারে দারিদ্র্য, ধারদেনা— তাই মোটা মজুরির আশায় বাইরে কাজে গিয়েছিল। তার আগে প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল বাবুজানের কাছ থেকে। সেই টাকা ফেরত দিতে চাপ দিচ্ছিল বাবুজান। এদিকে একলপ্তে ৫ লাখ টাকা না দিলে বাবুজানের ঝাড়খণ্ডের পরিবারের কাছে চলে যাবে বলে হুমকি দিচ্ছিল কাজল। আর তখনই সামাজিক প্রতিষ্ঠা রক্ষায় চরম সিদ্ধান্তে নেয় বাবুজান।

গত রবিবার কাজলের মোবাইল বন্ধ হয়ে গেলে গোয়া থেকে অজয় ফোনে বার বার স্ত্রীর খোঁজ করে। শুধু শ্বশুরবাড়ি নয়, বাবুজানকেও সে ফোন করে খোঁজ নিতে বলে। বাবুজান তখন মোটরবাইকে করে কাররু, সিরকাডি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন খোঁজ করছে— অথচ হত্যার নেপথ্যে মূল হোতা সে-ই। তার আরও চালাকি— অজয়ের সন্দেহ দূর করতে বাবুজান নিজেই বিজয়ের সঙ্গে তার কথা বলায়।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, প্রায় ১৫-২০ দিন বাবুজান ও কাজলের দেখা হয়নি। রবিবার দেখা হওয়ার পর টাকা নিয়ে তীব্র বাকবিতণ্ডা। রাগে কাজল লাথি, চড়-থাপ্পড় মারে বাবুজানকে। মুহূর্তেই মাথায় আগুন লাগে। তবু বাইরে শান্ত ভাব নিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। তারপর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে খুন।
এ সময় কিছুটা দূরে বিজয় নিজের প্রেমিকা রাধার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত ছিল। বাবুজান ডেকে জানায়— কাজলকে মেরে ফেলেছে। রাধা খুনের পরিকল্পনা তখনই পাকা হয়। নিজের প্রেমিকাকে খুনে সাহায্য করে বিজয়। একইভাবে ওড়না পেঁচিয়ে খুন হয় রাধা। পরে তাদের টার্গেট হয় ছোট্ট রাখি।
খুনের পরের দিন, সোমবার ভোরে রেললাইনে তিনটি দেহ উদ্ধার হয়। তখনও অভিনয় চালিয়ে যায় বাবুজান— ফোনে অজয়কে খবর দেয়, এমনকি এলাকার এক সিভিক ভলান্টিয়ার পাঠানো বলে মৃতদেহগুলির ছবি অজয়ের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায়। অজয়ের একটাই উত্তর— “সব শেষ হয়ে গেল”।
বৃহস্পতিবার ফরেনসিক দল ঘটনাস্থল ও মৃতদেহ উদ্ধারের জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। পাশাপাশি নিহতদের বাড়ি ও যে মোবাইল দোকানে ফোন সারানো হয়েছিল, সেখান থেকেও প্রমাণ জোগাড় করে। গোয়া থেকে ফেরা অজয়কেও নানাভাবে জেরা করেছে পুলিশ।
তদন্তকারী এক আধিকারিকের কথায়, “সম্পর্কের জটিলতা, টাকার টানাপোড়েন আর অবিশ্বাস— মোটিভের এই ত্র্যহস্পর্শে সুইসার ট্রিপল মার্ডার। পুনর্নির্মাণে সেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল।”










Post Comment