insta logo
Loading ...
×

এসো মা, চোখের জল মুছিয়ে দাও

এসো মা, চোখের জল মুছিয়ে দাও

সুজয় দত্ত

মা আসছেন। জগজ্জননীকে বরণ করতে তৈরি বাঙালি। জমে উঠতে শুরু করেছে পুজোর বাজার। আর তার মাঝেই দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর বৃষ্টি হয়েছে এখনও পর্যন্ত ৭৬ শতাংশের বেশি। তবে ক্যালেন্ডারে বর্ষা বিদায় নিলেও বাস্তবে কবে বর্ষার বিদায় বলতে পারছে না আবহাওয়া অফিস। এমনকি সেপ্টেম্বরের শেষে পুজো, পুজোর দিনগুলোতে কি বৃষ্টি হবে না শুকনো আবহাওয়া থাকবে, তার দিকেই তাকিয়ে কিশোরী -তরুণী মহল।

সেপ্টেম্বর শুরু হচ্ছে। মা দুর্গা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আর দেরি নেই।“সপরিবারে আগমন।” তাই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি নামতে হবে। কিন্তু মা মনে মনে চিন্তিত। একরাশ চিন্তা নিয়ে গণ্ণু দাদা সদ্য ফিরে এসেছেন মর্ত্য ধাম থেকে। ছেলের রেইকি রিপোর্ট হাতে পেয়ে যথেষ্ট চিন্তিত মা দুর্গা। লক্ষ্মীদেবীও চিন্তিত।

লক্ষ্মী বলল,
—মা, এবছর কীরকম ভাবছ? ভাই তো খবর এনেছে প্যান্ডেল, আলোর ঝলক, শপিং মল, সব তো ফিটফাট।

দুর্গা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—তা তো বটেই। কিন্তু দেশের কী অবস্থা দেখেছ? কারও চাকরি নেই, কারও ধান শুকোচ্ছে না, কারও বেতন সময়মতো আসে না। আবার অনেকে রাতে উড়ো আলো ঝলকাচ্ছে, দিনে সেলফি তুলছে—‘মা আসছেন’।

লক্ষ্মী হেসে ফেলল, এ হাসিতে মেশানো বিষাদ।
—তোমার নাম দুর্গা, তাই তোমাকে দুর্গতি দূর করার দায়িত্ব নিতে হয়। আমি তো শুধু টাকাপয়সার দায়িত্ব নিই। তবে শুনলাম টাকা আছে, কিন্তুও জিনিসপত্রর দাম এত বেড়েছে যে আমজনতার নাভিশ্বাস। সবজি টবজির দাম আকাশ ছোঁয়া। সঙ্গে আমেরিকা যে শুল্ক চাপিয়েছে তাতে দেশের বাজারে আর্থিক মন্দা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

—সেটাই তো বলছি, মাগো। —মা দুর্গা চোখ বড় করে বললেন, —এবার বাপের বাড়ি যাবো তো, জামাইদের হাতে হাতে দেবো কী?
—গতবার ছিল অভয়া কাণ্ড। এবারে শুনছি, বাংলার ছেলে-মেয়েরা ভিন রাজ্যে গিয়ে মার খাচ্ছে। হাজার হাজার শ্রমিক পুজোর মুখে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমে দলে দলে ফিরে আসছে। ওরা তো আমার সন্তান, ওদের এই অবস্থা দেখে কী করে আনন্দে নামি?

কার্তিক এবারও বেশ মাঞ্জা দিচ্ছে। পাশ থেকে ফুট কেটে বলল,
—আমার নামেই যত হাসাহাসি হয়। কেউ চাকরি দিতে চায় না। বলে “কার্তিক হল অকর্মা”। কিন্তু আমি কী করব? যে দেশে নূন্যতম কর্মসংস্থান নেই, সেখানে আমায় অকর্মা বললে দোষ কী?

সরস্বতী বই গুটিয়ে বললেন,
—এ দেশে জ্ঞান আছে, তবে পরীক্ষার ফলাফলে খাতা হারায়। স্কুলে শিক্ষক নেই, কলেজে আসন নেই। সবাই গুগল-ভগবানকে পূজা করছে। আমার এখন আর কেউ দরকারই মনে করে না।
—আমার জন্যও লজ্জার খবর আছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি গেছে অনেক যোগ্য শিক্ষকেরও। যোগ্যরা আবার বসছে নতুন পরীক্ষায়। নিয়োগ দুর্নীতির কোন কিনারা হলই না। কারা দোষী শাস্তি পেলো না, অথচ যোগ্য পরীক্ষার্থীরা শাস্তি পেয়ে গেলো। ওরা তো বলতেই পারে, এত শিক্ষা সত্বেও যদি আদালত এক কলমে সব মুছে দেয়, তবে আমার পূজা করে লাভ কী?

গণেশ গম্ভীর মুখে বলছেন, “আমাকে এখন ব্যবসায়ীরা খুব ডাকে। দাদাগিরি, চুক্তি, টেন্ডার—সব জায়গায়। কিন্তু দুর্নীতির ভিড়ে আমিও আটকে যাই। কার ভক্তি নেব, কাকে ছেড়ে দিই—এই হিসেব করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে যায়। আর সুযোগ বুঝে অসাধু ব্যবসায়ীরা আমায় উলটে দেয়। আমি তো শুরু থেকেই জানতাম, এই রাজ্যে চাকরির দেবতা হওয়া দায়!”

লক্ষ্মী ঠোঁট কামড়ে বললেন, “হ্যাঁ, বাংলায় ১০০ দিনের কাজও তো বন্ধ। গ্রামে বেকার ছেলেরা খালি চৌকাঠে বসে আঙুল গুনছে। ভিন রাজ্যে খাটতে যাচ্ছে তারা। আবার বাংলায় কথা বললে বাংলাদেশী সন্দেহে পেটানো হচ্ছে তাদের। রাজ্যে বেকারত্ব বন্ধে শ্রমশ্রীর পাঁচ হাজার, আর ভিন রাজ্যে কাজে গেলে জুটছে মার।”

কার্তিক বলে উঠল, “শুধু বেকারত্ব নয় মা, ইডি-সিবিআইয়ের খেলাও শুরু হয়ে গেছে। ভোট সামনে বলেই বোধহয়। শুনছি পুরুলিয়াতেও নাকি সেই কয়লা কাণ্ডের পর এবার শিক্ষা দুর্নীতি খুঁটতে এসেছে ওরা।”

লক্ষ্মী বিরক্তি নিয়ে বললেন, “কেন্দ্র আর রাজ্য, কারা কাকে টানছে বোঝা দায়। ওই টানাটানিতে জনগণ রশির মতো মাঝখানে পড়ে যাচ্ছে।তবুও মা, চারদিনের জন্য সবাইকে একটু ভুলিয়ে আনন্দ দিতে হবে। তবে সাবধান, এখনকার মানুষরা ঢাক-ঢোলের ফাঁকে গলা চড়িয়ে বলবে—‘মা, একটু বদলাও না পরিস্থিতি’।”

দুর্গা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
—সামনের বছর আবার ভোট। তখন এই টানাটানি আরও বাড়বে। আমি নামব বটে, কিন্তু মর্ত্যে নেমে আনন্দের চেয়ে চিন্তাই বেশি লাগছে। সপরিবারে নামছি বলেই হয়তো এই মর্ত্যের ছেলেমেয়েরা ভরসা পায়। না হলে এত টানাটানি, এত দুর্নীতি, এত দুঃখের মাঝেও কার সাধ্যি হাসি মুখে পুজো করে!

সরস্বতী মাকে সনর্থন করে বললেন,
“তা হলে এবারে এভাবেই নামি। মানুষকে একটু দেখাই, শুধু সাজসজ্জা নয়, একটু ভেবে দেখুক চারদিন পর মায়ের বিদায়ের পরে জীবনটা কেমন চলে।”

লক্ষ্মী মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
“ঠিকই বলেছ। তবে সাবধান মা, পুজোর ভিড়ে কেউ যদি আবার বলে—‘মা, একটু সেলফি দাও না’, তখন যেন রাগ করো না। এই দেশে দেবতারও এখন পাবলিসিটি ম্যানেজার দরকার।”

Post Comment