সুইটি চন্দ্র ও নিজস্ব প্রতিনিধি, বাঘমুন্ডি:
যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো গ্রামl কিন্তু দুর্গম গ্রামে এখনও পায়ে পায়ে বাধা। বহু প্রতিবন্ধকতা। পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি ব্লকের অযোধ্যা পাহাড়ের একেবারে প্রত্যন্ত জনপদ জিলিংসেরেং। সেখানেই শিক্ষার নতুন দিশা দেখাচ্ছেন এক আদিবাসী বধূ মালতী মুর্মু।
টিনে ছাওয়া একটি মাটির ঘর থেকেই তিনি চালাচ্ছেন এক অনন্য শিক্ষা উদ্যোগ। যেখানে ৪৫ জন খুদে পড়ুয়া প্রতিদিন অলচিকি হরফে সাঁওতালি ভাষায় পাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ। সেই সঙ্গে বাংলা মাধ্যমের পাঠ দান। শেখানো হচ্ছে গানও। মালতী দেবী নিজে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখেন, গ্রামের শিশুদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ একেবারেই নেই। অধিকাংশ শৈশব কাটে জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে। পরে তা বাজারে বিক্রি করে। কিন্তু এই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে পারেননি তিনি। স্বামী বাঁকা মুর্মুর সঙ্গে আলোচনা করে কয়েকজন শিশুকে নিয়ে নিজের ঘরেই পড়ানো শুরু করেন। চালু হয় মালতীর
বিদ্যালয়।
২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় এই অনন্য স্কুল। প্রথমে মালতী দিদিমনির বাড়িতে। তারপর একটি ঝুপড়িতে। এরপর গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় তৈরি হয় দুটি ক্লাস ঘর। প্রথম থেকেই চলছে বিনামূল্যে পাঠদান। মালতী মুর্মু বলছেন, “প্রথমে নিজের বাড়ি। তারপর
পাতা-খড় দিয়ে বানানো একটি ঝুপড়িতে শুরু করেছিলাম। পরে কাঁচা মাটি ও টিনের চালা দিয়ে ঘর তৈরি হয়। এখন ওখানেই প্রতিদিন ক্লাস হয়।” মালতীর স্বামী বাঙ্কা মুর্মু বলেন, “বিয়ের পর মালতী আমাকে জানায়, শিক্ষার অভাবে এই গ্রাম অনেকটা পিছিয়ে। ও বলে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের পড়াবে। তাদেরকে স্কুলমুখি করবে। কমাবে স্কুলছুট। তখন আমি ওকে সমর্থন করি। ওর উদ্যোগে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার স্বাদ পাচ্ছে। কাঠ বেচার বদলে তারা এখন বইয়ের পাতায় মুখ দিচ্ছে।” আসলে জিলিংসেরেঙ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন স্থায়ী শিক্ষক ও দু’জন পার্শ্ব শিক্ষক থাকলেও তারা নিয়মিত পাহাড়চূড়োর এই গ্রামে আসেন না।

অধিকাংশ দিনই বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু হওয়া স্কুল দুপুর দেড়টাতেই ছুটি হয়ে যায়। তাই এখানকার শিক্ষার ভরসা হয়ে উঠেছে মালতীর স্কুল। তার স্কুলের জন্যই স্কুলমুখি হচ্ছে এ গাঁয়ের কচিকাঁচারা। ২০২০ সালে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল মাত্র ৭-৮ জন। এখন বেড়ে হয়েছে ৩০। কমছে স্কুলছুটও। তাই এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছেন গ্রামবাসীরাও। স্থানীয় বাসিন্দা সুনিতা মান্ডি বলেন, “আমাদের ছেলে-মেয়েরা এখন মাতৃভাষায় পড়াশোনা করতে পারছে। এতে তাদের আগ্রহ যেমন বাড়ছে। তেমনই ভবিষ্যত নিয়েও স্বপ্ন দেখতে শিখছে।” বর্তমানে প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে সাড়ে আটটা। কোনদিন আবার সকাল ন’টা। আড়াই থেকে তিন ঘন্টা মালতীর পাঠ দান চলে। মালতী মুর্মু চাইছেন, আগামী দিনে সকাল ও সন্ধ্যায় দুটি আলাদা শিফটে ক্লাস নিতে। যাতে আরও বেশি শিশুকে শিক্ষার পরিসরে আনা যায়। তবে পরিকাঠামো ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকারি সহায়তা এখনও সীমিত। মালতীর কথায়, “কখনও পুরোনো জামাকাপড় বা সামান্য কিছু টাকাই পাওয়া যায়। তবে তা দিয়ে স্কুল চালানো সম্ভব নয়। আমরা সংসারের কথা না ভেবে স্কুল চালাচ্ছি। যদি সরকার পাশে দাঁড়ায়, তাহলে আরও ভালোভাবে এই স্কুল চালানো সম্ভব।” তাই ওই দিদিমণি ও তার স্বামীর স্বপ্ন
এরপর গ্রামের ছেলে- মেয়েদের পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ দান।
একজন গৃহবধূর মনোবল ও সংকল্প যে কীভাবে একটি সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পারে। তার জীবন্ত উদাহরণ হয়ে উঠেছেন মালতী মুর্মু।
Post Comment