নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া
টানা বর্ষণে নাকাল পুরুলিয়া জেলা। একের পর এক নিম্নচাপের জেরে গত কুড়ি দিনে স্বাভাবিক বৃষ্টির দ্বিগুণেরও বেশি জল পড়েছে জেলাজুড়ে। চাষের জমিতে জমে থাকা জলে ভেসে যাচ্ছে বীজতলা, কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সেই সঙ্গে কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়ায় বাড়ছে বসতভিটে হারানোর আতঙ্কও।

সোমবার মহেশনদীতে একটি নৌকায় মাছ ধরতে গিয়েছিলেন দুজন। আচমকা বজ্রপাতে জখম হয়ে নদীতে তলিয়ে মৃত্যু হলো নিতুড়িয়ার লখিয়াবাইদ গ্রামের পিন্টু সিং(৩৬)য়ের। জখম তার সঙ্গী সুলুঙ্গার দিলীপ মাহাতো। স্থানীয়দের তৎপরতায় দিলীপ মাহাতোকে রঘুনাথপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে প্রথমে পিন্টু সিংয়ের খোঁজ মেলেনি। নদীতে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ ও বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর।নিখোঁজ যুবককে এদিন সন্ধ্যায় মহেশ নদী থেকে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করেন। রঘুনাথপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পুরুলিয়ার কৃষকদের কষ্টের ছবি যেন প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের এক নিদারুণ দলিল। জুন মাসের গোড়ায় যেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪১.৫৪ মিলিমিটার, সেখানে পরপর তিনটি নিম্নচাপের কারণে সোমবার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৬৫৪.৫ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ১০০ শতাংশ বেশি।
চাষের জমি জলমগ্ন হয়ে পড়ায় আমন ধানের চারা রোপণই শুরু করা যাচ্ছে না। জেলার একাংশে বীজতলা তৈরি হলেও টানা বৃষ্টিতে সেই বীজতলাও ধুয়ে যাচ্ছে। চাঁদরাডি গ্রামের প্রবীণ কৃষক কৃষ্টপদ গোপ বলছেন, “এমন অবস্থা কখনও দেখিনি। সামান্য রোদের জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছি। বীজতলা ধুয়ে যাচ্ছে। এক ছটাক জমিতেও চারা বসাতে পারিনি।”

আড়শার গৌরাদাগ গ্রামের বুলেট মাহাতো, বামুনডিহার অশ্বিনী মাহাতোও একই সুরে বলছেন, “চারা তো দূরের কথা, জমি তো কাদা আর জলে একাকার। চাষ শুরু করার অবস্থায় নেই।”
পুরুলিয়া কৃষি দপ্তরের দাবি, বোরো ধানের মতো পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি হয়েছে। উপকৃষি অধিকর্তা আদিত্য দুয়ারির কথায়, “অধিকাংশ কৃষক বীজতলা তৈরি করে ফেলেছেন। এখন বৃষ্টি কমলেই চারা রোপণ শুরু হবে। এবার বৃষ্টিপাত অনেক বেশি হয়েছে।” তবে ইতিমধ্যেই ৩০০০ হেক্টর জমিতে চারা রোপণের কাজ শেষ হয়েছে। যদিও এবারের আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা গতবারের চেয়ে কমিয়ে ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার হেক্টর করা হয়েছে।
এদিকে অতিবৃষ্টিতে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি। গত ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ষণে ক্ষতির পরিমাণ ৩৫ লাখ টাকার বেশি। নতুন করে টানা বৃষ্টিতে সেই সংখ্যা বাড়তে বসেছে। রবিবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে সোমবার সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত ২৩.৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি ঝালদায়—৫৫.৬ মিলিমিটার। আকরো-রঘুনাথপুর রাস্তায় কজওয়ের উপর দিয়ে জল বইছে, ফলে যান চলাচল বন্ধ।
বৃষ্টির প্রকোপে ভেঙে পড়ছে কাঁচা বাড়ি। বান্দোয়ানের মুদিডি গ্রামের মৃত্যুঞ্জয় মুদির বাড়ি ভেঙে যায় রবিবার ভোরে। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বাড়ির বাইরে থাকায় প্রাণে বাঁচেন। মৃত্যুঞ্জয় বলেন, “আমার নাম আবাসের তালিকায় নেই। বউ নিয়ে কোথায় থাকব বুঝতে পারছি না। বিয়েটা হয়তো পিছোতে হবে।”
ধনঞ্জয় মুদির বাড়ির রান্নাঘর ভেঙে পড়েছে। পরিবার ত্রিপলের আশায় ব্লক অফিসে গিয়ে ফিরে এসেছে খালি হাতে। বাধ্য হয়ে ভাঙা ঘরের এক কোণে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
মানবাজারের সবজি বিক্রেতা বিবেকানন্দ বাউরী বলেন,
“সকালে বাজারে সবজি নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু বৃষ্টির জন্য ক্রেতা নেই বললেই চলে। অনেকটাই সবজি ফিরে নিয়ে যেতে হবে। প্রতিদিনের যা বিক্রি হয়, তার অর্ধেকও হচ্ছে না আজ।”
অন্যদিকে, টোটো চালক মজিল আনসারী জানান,
“সকাল থেকে দু-একজন যাত্রী উঠেছেন। ভাড়া করে ঘুরে বেড়ানো দূরের কথা, লোকজন প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন না। রোজগার একেবারেই শূন্যের কাছাকাছি।”











Post Comment