insta logo
Loading ...
×

শার্দূল সুন্দরী জিনাত আর কিলা আনল জঙ্গলমহলে নতুন ভোর

শার্দূল সুন্দরী জিনাত আর কিলা আনল জঙ্গলমহলে নতুন ভোর

সুজয় দত্ত,পুরুলিয়া:

২৯ জুলাই, আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস।

জঙ্গল যেমন নির্জন, তেমনই গোপন। সেখানে প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি পায়ের ছাপ একেকটি অমীমাংসিত গল্প। আর এমনই এক গল্প লিখে গেল পূর্ব ভারতের দুই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার—একজনী বাঘিনী, নাম জিনাত। আর এক ভবঘুরে বাঘ, নাম কিলা। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের উপস্থিতির চিহ্ন। এই গল্প শুধুই দুটি বাঘের নয়, এই গল্প প্রকৃতির প্রতিশোধের, ভালবাসার, পুনরুদ্ধারের, এবং নতুন আশার।

২০২৪ সালের ১৫ নভেম্বর। মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে এক তিন বছরের ডোরাকাটা বাঘিনীকে আনা হয় ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে। উদ্দেশ্য ছিল জিনগত বৈচিত্র ফিরিয়ে আনা। সিমলিপালের অধিকাংশ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারই মেলানিস্টিক—অর্থাৎ গা প্রায় পুরোপুরি কালো। এই বাঘিনীর সংমিশ্রণে তৈরি হোক নতুন জিনবৈচিত্র্যের সম্ভাবনা—এই ছিল বনদপ্তরের লক্ষ্য। তার নাম রাখা হয় জিনাত। গলায় পরিয়ে দেওয়া হয় রেডিয়ো কলার। ক’দিন রাখা হয় ক্যাপটিভ এনক্লোজারে। তারপর ২৪ নভেম্বর তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয় সিমলিপালের গভীর জঙ্গলে।

কিন্তু প্রকৃতির নিজের ছক থাকে। জিনাত সেই মুক্ত জীবন স্থায়ী করল মাত্র চার দিন। এরপরই সে পথ ধরে চলতে থাকে উত্তর-পশ্চিম দিকে। পেরিয়ে যায় সিমলিপাল, ঢুকে পড়ে ঝাড়খণ্ডে। চাকুলিয়া রেঞ্জ, রাজাবাসা, বেলপাহাড়ির কাটুচুয়া জঙ্গল পেরিয়ে ২২ ডিসেম্বর সে প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়ে। তখন থেকেই বনদপ্তরের কড়া নজর তার ওপর। সেদিন থেকেই শুরু হয় আরেক অভিযান—নাম না থাকলেও পরে যার নাম হয় ‘অপারেশন জিনাত’।

২৭ ডিসেম্বর সে পৌঁছয় মানবাজার ২ নম্বর ব্লকের পাইসাগড়া জঙ্গলে। সেখানে তাকে ধরার জন্য খাঁচা, জাল, ডার্টগান সবই তৈরি ছিল। কিন্তু চতুর জিনাত ফাঁদ কাটিয়ে জাল সরিয়ে চম্পট দেয়। পাল্টে ফেলে এলাকা। পরদিন চলে যায় বাঁকুড়ার রানিবাঁধের গোপালপুর জঙ্গলে। ফের অভিযান, ফের ব্যর্থতা।

সবশেষে ২৯ ডিসেম্বর, রানিবাঁধের গোঁসাইডি জঙ্গলে ছোঁড়া হয় ষষ্ঠ ঘুমপাড়ানি গুলি। এবার আর লক্ষ্যচ্যুতি হয়নি। সুন্দরবনের ডেপুটি রেঞ্জার মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের ছোঁড়া গুলিতে জিনাত অচেতন হয়ে পড়ে। তাকে দড়ি বেঁধে ডুলিতে তুলে আনা হয় খাঁচায়। তখনও সে উঠে বসে প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ছক সফল। শেষ হয় এক দীর্ঘ তল্লাশি ও অনুসন্ধানের পর্ব।

এই অভিযানে ছিলেন সুন্দরবনের পাঁচজন অভিজ্ঞ সদস্য—মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস, রাজীব নস্কর, কালীপদ গায়েন, শম্ভু দাস এবং পশুচিকিৎসক শঙ্কর বিশ্বাস। তাঁরা ২০ ডিসেম্বর ঝাড়গ্রামে এসে পৌঁছন, সঙ্গে দুটি রাইফেল ও একটি পিস্তল। প্রথমে কাঁকড়াঝোরে জিনাতের গন্ধ পাওয়া যায়। ২২ ডিসেম্বর তাঁরা ঘাঁটি গাড়েন বান্দোয়ানে। সেখান থেকেই শুরু হয় ফাঁদ পাতা, গাছে উঠে শুটারের অবস্থান নেওয়া, ডার্ট ছোড়ার পালা। জিনাত একাধিকবার বুদ্ধি খাটিয়ে সেই জাল ফাঁকি দেয়। কিন্তু শেষমেশ সফল হয় বনদপ্তর।

বাঘিনীকে খাঁচায় তুলে আনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই প্রশংসা করেন বনদপ্তরের টিম ওয়ার্কের। লেখেন, “এই উদ্ধার আসলে টিমওয়ার্ক এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রতি নিবেদিতপ্রাণের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।”

কিন্তু গল্প এখানেই থামেনি।

ঠিক যেদিন জিনাতকে খাঁচায় তোলা হয়, তার পরদিনই পুরুলিয়া সীমান্তের ঝাড়খণ্ড অংশে, চান্ডিলের বালিডিতে দেখা যায় বাঘের পায়ের ছাপ। মেরে ফেলে গরু ও বাছুর। ২ জানুয়ারি তুল গ্রামের কাছে আবার দেখা যায় বিশাল পায়ের ছাপ। এক বালক জানায়, সে গাছের ডালে লুকিয়ে বেঁচে গিয়েছে। নিচে দাঁড়িয়ে ছিল বাঘ।

প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল—লেপার্ড না চিতাবাঘ? কিন্তু অভিজ্ঞরা জানান, বাঘ গাছে ওঠে না, আর গাছের তলায় এত বড় পায়ের ছাপ একমাত্র রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারেরই হতে পারে।

তৎক্ষণাৎ রেড অ্যালার্ট। চান্ডিল, বাঘমুন্ডি, বলরামপুর, মাঠা—সব জায়গায় নজরদারি, ক্যামেরা বসানো, মাইকিং শুরু। দেখা যায়, বাঘটি প্রতি রাতে হাঁটছে প্রায় ১৪-১৬ কিলোমিটার। তার চলন, শিকার, গতিবিধি দেখে বোঝা যায়—এ কোনো হারিয়ে যাওয়া বাঘ নয়। এ এক সুনির্দিষ্ট মিশনে এসেছে। সে ফিরে আসছে বারবার।

কিছুদিনের মধ্যে জানা যায়, এই বাঘই সম্ভবত পালামৌ টাইগার রিজার্ভ থেকে আসা পুরুষ বাঘ—নাম কিলা। ২০২৩ সালের অক্টোবরে পালামৌ দুর্গের কাছে দেখা গিয়েছিল তাকে। তারপর থেকেই নাম হয়েছিল কিলা—অর্থাৎ দুর্গ।

১২ জানুয়ারি সে ঢোকে বাংলায়। প্রথম কিছুদিন কেবল ছায়া। ১৭ জানুয়ারি বান্দোয়ানের জানিঝোড় গ্রামে এক ব্যক্তির মুখোমুখি হয়। চোখে চোখ রেখে চলে যায়। ১৮ জানুয়ারি প্রথম ট্র্যাপ ক্যামেরায় ছবি ধরা পড়ে ভাঁড়ারির জঙ্গলে।

এরপর টানা ৪৮ ঘণ্টার চেষ্টায় তাকে ধরার চেষ্টা হয়। কিন্তু সে ফিরে যায় ঝাড়খণ্ডে। আবার আসে। আবার ছবি ধরা পড়ে। আবার হারিয়ে যায়। ২৬ জানুয়ারি বান্দোয়ানে এক কৃষক সর্বেশ্বর মান্ডি নিজের চাদর ঘুরিয়ে তাড়িয়ে দেন কিলাকে—ঘটনা শুনে চমকে ওঠে বন দফতরও। এরপর কিলা চলে যায় দক্ষিণ বাঁকুড়ায়, আবার দলমায়। ১ মার্চ শেষবার ধরা পড়ে ট্র্যাপ ক্যামেরায়।

তারপর এক দীর্ঘ নিস্তব্ধতা। যেন কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে পড়ে কিলার অস্তিত্ব। কেউ দেখে, কেউ শোনে, কেউ শুধু বিশ্বাস করে।

এরপর আসে জুন। ২৫ জুন, ঝাড়খণ্ডের মারদু গ্রামে এক গৃহস্থের উঠোনে দেখা যায় বাঘ। খবর যায় বন দপ্তরে। ২৬ জুন তাকে ধরা হয়, এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় পালামৌ টাইগার রিজার্ভের কোর এলাকায়। সেখানে হয় ‘সফট রিলিজ’।

এমনকি জুনেই জানা যায় আর একটি আশ্চর্য তথ্য—সিমলিপালের জিনাত অন্তঃসত্ত্বা। আগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে আসছে তার শাবক। তার মানে সাফল্য এসেছে সেই জিনগত বৈচিত্র প্রকল্পে। এমনকি কিলা এখন ফের সিমলিপাল সংলগ্ন জঙ্গলে ঘোরাফেরা করছে। ট্র্যাপ ক্যামেরায় মিলেছে তার ছবি। বনদপ্তর সূত্রে জানা যাচ্ছে, তার জন্য আনা হচ্ছে নতুন সঙ্গিনী—যাতে তৈরি হয় এক শক্তিশালী বাঘ পরিবার।

এই জুটি, এই চলাচল, জঙ্গলে তাদের ছায়া রেখে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ফের চিহ্নিত হচ্ছে পূর্ব ভারতের দুটি প্রাচীন ব্যাঘ্র করিডর—একটি দলমা–চান্ডিল–বান্দোয়ান–বেলপাহাড়ি হয়ে ফের দলমায়। প্রায় ২৫০ কিমি দীর্ঘ এই পথেই ঘুরে বেড়িয়েছিল কিলা। আরেকটি করিডর, পালামৌ–হাজারিবাগ–রাঁচি হয়ে ঝালদা, কোটশিলা, অযোধ্যা—যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ কিমি।

এই দুটি করিডর আসলে এক বৃহৎ ছায়াপথের অংশ—যার পরিসর প্রায় ৭০০ কিমি। বনবিভাগের মতে, কিলা ও জিনাত সেই করিডরের আধুনিক পথিক। তাদের পায়ের ছাপ, চলাচল, শিকারের ধরন বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করা হয়েছে এই করিডর। প্রকৃতির নিজস্ব ছকে তৈরি এই করিডর যে আজও জীবিত, তা প্রমাণ করেছে এই জুটি।

এখন বাংলা-ঝাড়খণ্ড যৌথভাবে কাজ করছে করিডর রক্ষায়। পালামৌ থেকে শুরু করে বান্দোয়ান, ঝালদা, অযোধ্যা পর্যন্ত বসানো হচ্ছে ট্র্যাপ ক্যামেরা। সরানো হচ্ছে গ্রাম, বাড়ানো হচ্ছে শূকর ও চিতলের সংখ্যা। ঘাসঝোপ তৈরি হচ্ছে যাতে বাঘের স্বাভাবিক চলাচল সহজ হয়। শুধু পুরুলিয়ায় তৈরি হচ্ছে ৫০০ হেক্টরের নতুন বন। ঝাড়গ্রামে আরও ২০০ হেক্টর। লাগানো হচ্ছে গামার, অর্জুন, জাম, এবং ঔষধি গাছ—যা বাঘেদের রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

জঙ্গলজুড়ে বসানো হচ্ছে ১০০টিরও বেশি ট্র্যাপ ক্যামেরা, নাইট ভিশন বাইনোকুলার, থার্মাল ড্রোন ও উন্নতমানের সিসিটিভি। মানুষের সঙ্গে বাঘের সংঘর্ষ যাতে না ঘটে, তার জন্য গ্রামবাসীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মাইকিং হচ্ছে, বনদপ্তরের কর্মীরা ২৪ ঘণ্টার নজরদারিতে রয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের আগে লালগড়ে এক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পিটিয়ে মারা হয়েছিল। তারপরই শিক্ষা নেয় প্রশাসন। এখন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে তৈরি হচ্ছে এক সুরক্ষিত ব্যবস্থা।
এমনকি ২০১৮-১৯ সালে কোটশিলার সিমনি বিটে দেখা গিয়েছিল একটি বাঘ। তার পায়ের ছাপ আজও রয়েছে সংরক্ষিত অবস্থায় বনদপ্তরের অফিসে। যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে, “আমি এসেছিলাম, আমি আবার আসব।”

এবার এসেছিল কিলা। জঙ্গলের প্রতিটি ঝোপে, প্রতিটি টিলায় তার গন্ধ রয়ে গেছে। বনদপ্তরের মতে, এ আসা নিছক এক ভবঘুরের নয়—এ ছিল টেরিটরির সন্ধানে, এবং সম্ভাব্য স্থায়ী আবাসনের ইঙ্গিত।

এই মুহূর্তে রাজ্যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১০২—এর মধ্যে ১০১টি সুন্দরবনে, ১টি বক্সায়। কিন্তু জঙ্গলমহলে যে বাঘ ফিরছে, তার সাক্ষ্য রেখে যাচ্ছে কিলা ও জিনাত।

পুরুলিয়ার ডিএফও অঞ্জন গুহের কথায়, “আমরা জঙ্গল কাটার দাপট রুখতে পেরেছি। আগুন নিয়ন্ত্রণে। ফলে গাছপালা বেড়েছে, হরিণ-শূকর ফিরে এসেছে। পাহাড়ি ঝোরা এনেছে জলধারা। খাবার, জল, আশ্রয়—সবই আছে। এ যদি বাঘের জন্য আদর্শ পরিবেশ না হয়, তবে আর কী?”

জঙ্গল ফিরে পেয়েছে প্রাণ। গাছের ডালে, পাতার ফাঁকে, ছায়ায়-ছায়ায় শোনা যাচ্ছে গর্জনের প্রতিধ্বনি।
আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবসে সেই গর্জনই যেন বলে দেয়—“আমি ফিরব। আমার পথ খোলা রেখো।”
আর কিলা-জিনাতের এই গাথা হয়ে উঠুক বাঘ রক্ষার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য পোস্টার ছবি।

Post Comment