insta logo
Loading ...
×

বাপ-ছেলের নাচে ভবিষ্যত খুঁজে নিচ্ছে ইতিহাস, পুজোয় নাটুয়া জয় করছে মঞ্চের পর মঞ্চ

বাপ-ছেলের নাচে ভবিষ্যত খুঁজে নিচ্ছে ইতিহাস, পুজোয় নাটুয়া জয় করছে মঞ্চের পর মঞ্চ

নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া :

পালার মঞ্চে বাবা-ছেলের এক যোগে নাচ। গুণধর সহিস আর তাঁর ছেলে তাপস একসঙ্গে উঠলেই নাটুয়ার নাচে ফেরে নতুন ছন্দ। একদিকে অভিজ্ঞতার দৃঢ়তা, অন্যদিকে তরুণের তারুণ্য। যুগলবন্দি যেন নাটুয়াকে নতুন দিশা দিচ্ছে।

ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা নাটুয়া শিল্পকে নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছেন গুণধর। পুরুলিয়ার পুঞ্চা ব্লকের কোনাপাড়া গ্রামের এই শিল্পী নয় পুরুষ ধরে নাটুয়া নাচের ধারাকে বহন করে চলেছেন। তাঁর ছেলে তাপসও এখন সেই ঐতিহ্যের শরিক। দু’জনকে একসঙ্গে দেখে শিউরে ওঠেন দর্শক। বাবার শরীরী শক্তি, দাঁতের জোরে ঢেঁকি তোলা বা গরুর গাড়ির চাকা ঘোরানোর দৃপ্ত ভঙ্গি মিলে যায় ছেলের তারুণ্যের ঝলকে।

পুরুলিয়ার পুঞ্চার কোনাপাড়ার শিব-দুর্গা নাটুয়া নৃত্য দলের ওস্তাদ গুণধর সহিসের বয়স এখন আটচল্লিশ। নয় পুরুষ ধরে এই পরিবারের রক্তে মিশে আছে নাটুয়া। বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে দিনমজুরির কাজ করেও তিনি মঞ্চ আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। আজ দেশের বাইরে পর্যন্ত নাটুয়ার আসর মাতিয়ে তোলেন। সেই ধারায় এখন যোগ হয়েছে ছেলে তাপস। বাবা-ছেলের যুগলবন্দিই এবার পুজোর মঞ্চে আলাদা নজর কাড়তে চলেছে।

এই পুজোয় ঢাকুরিয়া থেকে টালিগঞ্জ, মধ্যমগ্রাম থেকে সুন্দরবন— একাধিক অনুষ্ঠানের বরাত পেয়েছে গুণধরদের দল। জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগেই এ বার পুজোর মরশুমে তিনটি অনুষ্ঠানের বরাত পেয়েছে গুণধরদের শিব-দুর্গা নাটুয়া নৃত্য দল। সঙ্গে সরাসরি ডাক এসেছে আরও দুটি বেসরকারি সংস্থা থেকে। ষষ্ঠীতে ঢাকুরিয়ার বাবুবাগানে, সপ্তমীতে পি কে গুপ্তা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক কলোনিতে, অষ্টমীতে টালিগঞ্জে, একাদশীতে মধ্যমগ্রামে এবং লক্ষ্মীপুজোর পর সুন্দরবনে— একে একে সাজানো আছে মঞ্চ। প্রতিটি অনুষ্ঠানে বাবা-ছেলের যুগলবন্দিই আকর্ষণের কেন্দ্র।

তাপসের বয়স তিরিশের কোঠায়। বাবার মতোই নাচকে জীবনের কেন্দ্রে রাখতে চান তিনি। ছোটবেলা থেকেই গুণধরের সঙ্গে অনুষ্ঠান দেখে দেখে বড় হয়েছেন। এবার মঞ্চে নাচের ছন্দে যেন বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। বাবার হাত ধরে পাঁচ বছর বয়স থেকে নাটুয়ার আসরে যেতেন গুণধর। আজ নিজের ছেলেকে নিয়েই মঞ্চ মাতাচ্ছেন। নাচে শরীরী শক্তির এমন ব্যবহার— দাঁতে ঢাক বাজানো, কাঁধে মানুষ নিয়ে পাক খাওয়া, হাতে সিঁড়ি তোলা— দর্শককে হতবাক করে দেয়। শিল্পীর কথায়, ‘‘ঘরে যা জোটে তাই খেয়ে থাকি। আলাদা কিছু খাওয়া-দাওয়ার দরকার পড়ে না।’’

শিল্পী গুণধর বলছেন , ‘‘আমাদের পরের প্রজন্ম যদি এই শিল্পের সঙ্গে না জুড়তে চায়, তবে নাটুয়া টিকবে না। তাই ছেলেকে মঞ্চে নিয়ে এসেছি। পালা সাজানো, দর্শকের মন টানা— সবই ও শিখছে।’’

আন্তর্জাতিক মঞ্চও কম দেখেননি তিনি। প্যারিস, আরব, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব প্রান্তে নাটুয়া নাচিয়েছেন। মুম্বইতে একবার তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রয়াত বাপি লাহিড়ী। রাজধানী দিল্লিতে চব্বিশবারেরও বেশি অনুষ্ঠান করেছেন। কলকাতাতেও তাঁর নাটুয়া কার্যত ধারাবাহিক ভাবে চলছে।

তবু অভাব যায়নি সংসারে। আগেকার মাটির বাড়ি এখনও পুরোপুরি পাকা হয়নি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে তাপসকে কোনোমতে স্নাতক করানোর শপথ নিয়েছেন গুণধর। নিজে ক্লাস এইট পাস হলেও ছেলেকে শিক্ষিত করতে চান। ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যু, দিনমজুরির কাজ, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই— সবই তাঁর জীবনের অংশ। তবে নাটুয়ার নেশাই তাঁকে মঞ্চে বেঁধে রেখেছে।

গুণধরের এই উদ্যোগকে গুরুত্ব দিচ্ছে জেলা প্রশাসনও। তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘নাটুয়া প্রায় সাতশো বছরের প্রাচীন লোকশিল্প। যাতে হারিয়ে না যায়, তাই কর্মশালা, লোকপ্রসার প্রকল্পের মাধ্যমে নানা উদ্যোগ চলছে। আমাদের তত্ত্বাবধানে পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়েছে। শিল্পীদের আমরা সরকারি বরাত দিচ্ছি, পাশাপাশি সরাসরি সংস্থাগুলির সঙ্গেও যুক্ত করছি।’’

১৫ জন শিল্পীর এই দলে সরকারি বরাতের প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রত্যেকে পাচ্ছেন এক হাজার টাকা করে। সঙ্গে থাকছে খাওয়া-দাওয়া ও যাতায়াত খরচ। সুন্দরবনে তো নাটুয়ার পাশাপাশি গুণধরের ছৌ নৃত্য দলও মঞ্চে উঠবে। তাঁদের পালা ‘সন্ধ্যা আরতির জন্ম’ আর ‘অন্ধকাসুর বধ’ ইতিমধ্যেই তৈরি। দুর্গাপুজোর পর আরও একটি নতুন পালা মঞ্চে আসবে বলেও জানিয়েছেন গুণধর।

নাটুয়া নাচে এবার পালার বিষয় শিব-দুর্গার বিবাহ। নাম রাখা হয়েছে ‘হর-পার্বতীর মিলন’। পৌরাণিক কাহিনিকে ঘিরে যে নাচ, তা গুণধরের শরীরী শক্তি আর তাপসের চঞ্চলতায় মিশে এক অনন্য রূপ পাচ্ছে। নাটুয়ার আসল স্বাদ বজায় রেখেই নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে টেনে আনছেন গুণধর।

নাটুয়ার নাম উঠলেই এক সময় মনে পড়ত বলরামপুরের হাঁড়িরাম কালিন্দির কথা। আজ সেই আসর ধরে রেখেছেন গুণধররা। তাঁদের হাত ধরে পুরুলিয়ার এই লোকশিল্প নতুন প্রজন্মকে ছুঁতে পারছে। আর বাবা-ছেলের যুগলবন্দি দেখেই দর্শকেরা বলছেন, নাটুয়া এখনই থেমে যাওয়ার নয়।

Post Comment